কোনো রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যটা তার সংবিধানের অনুসৃত নীতিগুলো থেকে বুঝা যায়। আবার রাজনীতিবিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে রাষ্ট্রের বৈশিষ্টটাও ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যটা রাষ্ট্রে কতটা প্রতিফলিত হয়েছে তাও বিচার বিশ্লেষণের বিষয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনের অন্যতম হোতা বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিল। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে তার রাজনৈতিক কার্যকলাপের নীতি নির্ধারক হিসেবে খন্দকার মোশতাক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হোসেনের নেতৃত্বে তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের নেতারা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং টাঙ্গাইলের সামসুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি চর্চা শুরু করে। তখন দলটির মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। তৎকালীন নতুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ কে রফিকুল হোসেন (খয়ের মিঞা)। প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি গঠনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে আটক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পায় ২২৩টি আসন। আর এই ২২৩ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ছিল ১৪৩টি। এক কথায় আওয়ামী লীগ এতটাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল যে, পরবর্তী সময়ে ১৯৫৭ সালে বৈদেশিক পররাষ্ট্রনীতির কারণে পিকিংপন্থি ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ (ন্যাপ) গঠন করেন। তবে এই বিভক্তির পর দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগের ভেতরকার রাজনৈতিক আর্দশ যা থাকা দরকার, তার সঙ্গে দলের নীতিগত অবস্থান এবং নেতৃবৃন্দের ব্যক্তি জীবনে অনুশীলন করা আর্দশটার পার্থক্য থেকে যায়। বিভক্ত আওয়ামী লীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী লীগে চলে যায়। আর বড় অংশটা থেকে যায় মূল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম সংঘটিত করে চারটি মূলীতিকে সামনে রেখে, এই চারটি মূলনীতি হলো : জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এই চার নীতিকে ভিত্তি করে মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বাংলা জনপদের সাধারণ মানুষ অংশ নেয়। সাড়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি সাম্রাজ্যবাদীদের অংশ, অপরটি সমাজতান্ত্রিকদের। মহান মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবীর সোশ্যালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক অংশ বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়। আর এই ধরনের আন্তর্জাতিক সমর্থনে বাংলাদেশ মার্কিন মদতপুষ্ট পাকিস্তানিদের হারাতে সক্ষম হয়। এখানে প্রশ্ন হলো? যারা ওই সময় আওয়ামী লীগ করতেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থেকে দলটির নীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছেন, তারা কি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে বিশ্বাস করতেন? খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতো লোক আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী স্থান দখল করেছিল স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগে। উলিস্নখিত দুই ব্যক্তিসহ বেশ কিছু নেতা ওই সময় মৌলবাদকে মনস্তাত্ত্ব্বিকভাবে লালন করতেন। এই নেতারা বিশ্বের সোশ্যালিস্ট বস্নককে মানসিকভাবে মেনে নেয়নি। তারা ক্ষমতার মোহে সাময়িকভাবে সোশ্যালিস্ট বিশ্বকে সমর্থন দেয়। আওয়ামী লীগের ভেতরে স্বাধীনতা-উত্তর একটি স্নায়ুবিক দ্বন্দ্ব ছিল। তাই ১৯৭২ সালের সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্য প্রতিফলন হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। তাছাড়া যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তা দেখা যায়নি। রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের মনস্তাত্ত্বিক আর্দশ অনুশীলন আর সংবিধানে লিপিবদ্ধ আর্দশ যদি মিল না থাকে, তাহলে দেশের রাজনীতি অঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। যেমন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ ১৫ বছর একটানা দেশ শাসন করেছেন, তিনি কি প্রকৃতভাবে আওয়ামী লীগের আর্দশ লালন করতেন। তিনি তার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কখনো কওমি মাদার, কখনো আরবের প্রেরিত আর্দশিক, কখনো কঠিন সেকু্যলার নানারূপের আর্দশকে লালন করেছেন। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ডান বাম দক্ষিণ পশ্চিম সবার সঙ্গে তিনি গাঁটছড়া বেঁধেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য কি তা হাসিনার আমলে বুঝাটা কষ্টকর ছিল। তাই এ ধরনের সরকারের কারণে দেশে এক অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করে। তিনি হয়ে গিয়েছিলেন এক ধরনের স্বৈরাচার। তিনি সবাইকে তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করেছেন তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। ফ্যাসিবাদী হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার কারণে একপর্যায়ে এসে নিপতিত হলেন গভীর খাদে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা বৈশিষ্ট্যের মানুষের সমন্বয় রয়েছে। যেহেতু এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাই নানা সমাহারটা থাকাটাই স্বভাবিক। বর্তমান সরকার দেশের সাংবিধানিক কিছু বিষয়ের সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখানে প্রশ্ন হলো, এই সংস্কারটা কোনো আদর্শকে লালন করে হবে? প্রশ্নটা জাগে এই কারণে সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীতে যারা আছেন সবার রাজনৈতিক আর্দশের বৈশিষ্ট্যটা এক নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের যেমন সেকুল্যার পন্থি বৈশিষ্ট্যবাদীদের দেখা যায় আবার কঠিন মৌলবাদ অনুশীলনকারীরাও রয়েছেন। যেমন ড. আসিফ নজরুল, তার পুরো নাম মোহাম্মাদ নজরুল ইসলাম। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ একজন মানুষ ছিলেন। তাই তার নাম থেকে মোহাম্মদ ও ইসলাম বাদ দিয়ে তিনি হয়েছেন আসিফ নজরুল (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য)। যাই হোক আসিফ নজরুল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। জাহানারা ইমামের গণআদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের তথ্যউপাত্ত সংগ্রহে তিনি করেছিলেন অনেক পরিশ্রম। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের নিয়ে অনেক নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি প্রিন্ট মিডিয়ায় পাকিস্তানি দোসরদের স্বরূপতা উন্মোচন করেছেন প্রচন্ড সাহসিকতা নিয়ে। জামায়াতে ইসলামকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে তিনি বিভিন্ন মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন। তারপর হঠাৎ করে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেধাবী শিক্ষক হয়ে যান বিএনপি- জামায়াত ঘরানার বুদ্ধিজীবী। ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের পর তিনি সামনের সারিতে চলে আসেন। তাকে করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা। তার রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈশিষ্ট্য ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের কতটা মিল আছে? এই বিষয়টি নিরীক্ষণ করলে কি পাওয়া যাবে? তাই প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারটা যে হবে, এই সংস্কারটা আদর্শিকতাটা কি হবে? যদি রাষ্ট্রের, সরকারের এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের বৈশিষ্ট্যের মিল না থাকে তাহলে রাষ্ট্রটা সঠিকভাবে পরিচালিত হবে না। তাই রাষ্ট্র, সরকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের এক বিন্দুতে আসতে হবে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার গণ-অভু্যত্থান হয়েছে। অভু্যত্থান পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, আবার ফ্যাসিবাদই রাষ্ট্র পরিচালনার স্টেয়ারিংটা নিয়ে নিয়েছে। একেকটি অভু্যত্থানে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। প্রাণ দেওয়া শহীদদের রক্তের কোনো মূল্যায়ন হয় না শেষ পর্যন্ত। সংস্কারের মাধ্যমে যে কাঠামোটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তৈরি করবেন, এটা কি পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত হয়ে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা কতটা মেনে নিবেন তা বিবেচনায় রাখা দরকার।
বারবার প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদকে তাড়ানো হবে তারপর যেই লাউ সেই কদুই থেকে যাবে- এটা জনগণের কাম্য নয়। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে, প্রয়োজনে নিজেদের ভেতরকার শুদ্ধতাও যাচাই করা দরকার। তাহলে বাংলাদেশ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন :কলাম লেখক