ডিজিটাল আসক্তি দূর করতে হবে

প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

হাসনাইন রিজেন
ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে আমরা যেটা সবচেয়ে বেশি অপচয় করি, সেটা হচ্ছে সময়। আর এই সময় অপচয় করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে হাতে থাকা স্মার্টফোন। অন্য সব নেশাদ্রব্যের মতোই স্মার্টফোনও এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। স্মার্টফোনের ব্যবহার সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধও এই নেশায় আসক্ত। আপনার চলার পথে আশপাশে যেদিকে তাকাবেন, দেখবেন সবাই হাতে থাকা স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত। মানুষ মানুষের সঙ্গে অনুভূতি শেয়ার না করে শেয়ার করে স্মার্টফোনের রঙিন দুনিয়ায়। এতে করেই হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে থেকে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। বর্তমানে আমরা অনেকেই মুঠোফোন বা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছি। দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬-২০ ঘণ্টাই এই যন্ত্র নিয়ে পড়ে থাকি। যার কারণে পরিবার-আত্মীয়স্বজন থেকে একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আমাদের একটি নতুন জগত তৈরি হয়ে হচ্ছে, যা আমাদের শরীর-মনকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫-২৪ বছর বয়সিরা অন্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। অন্য এক গবেষণা বলছে, একজন মানুষ দিনে অন্তত ২৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিন স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিন স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোনো এসএমএস এলো কিনা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্প বয়সিরা দিন দিন ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে। বর্তমানে যারা দ্রম্নত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪-২৪ বছর অর্থাৎ তরুণ সমাজ। তাদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৬৩ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজি নামক ভিডিও গেম খেলে এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এসব ভিডিও গেম খেলার ফলে শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়; এমনকি চোখের দৃষ্টিশক্তির হ্রাসসহ মানসিকভাবে অনেকে বিকারগ্রস্ত হচ্ছে। চিকিৎসায় দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনে আসক্তি শিশুর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছে চোখের। তারা শিশুদের চোখের সমস্যার তিনটি কারণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে প্রথম কারণ হিসেবে উলেস্নখ করেছে কোনো কোনো শিশু চোখে সমস্যা নিয়েই জন্মায়। দ্বিতীয় ভিটামিন 'এ'র অভাবে শিশু রাতকানা রোগে ভুগতে পারে, এমনকি অন্ধও হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে শিশুরা চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে মাসে গড়ে সাড়ে তিন হাজার শিশু আসে। এর ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর তথ্যও অভিন্ন। ডাক্তারা এই রোগকে রোগকে বলেন 'কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম'। জাতিসঙ্ঘের শিশু-বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার শিশু নতুনভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কম্পিউটার, টিভি ও মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে জীবনের সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের শিশুরাও যুক্ত হচ্ছে কম্পিউটার, টিভি, মোবাইল ট্যাবের সঙ্গে। কিন্তু অতি আসক্তির কারণে তাদের একটি বড় অংশ সর্বনাশের শিকারও হচ্ছে। শুধু দৃষ্টিশক্তির সমস্যা নয়, নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যারও শিকার হচ্ছে তারা। এই বিপজ্জনক ধারা থেকে শিশুদের রক্ষায় বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে। শিশুরা যাতে কম্পিউটার বা মোবাইল আসক্তি নামের সর্বনাশের দিকে পা না বাড়াতে পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মোবাইল আসক্তি শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই নয়, বরং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এখন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে জানা যায়, ৪৬ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহারকারী 'ফোন ছাড়া বাঁচবই না' এমনটিই মনে করেন। মূলত এই আসক্তি তাদের রীতিমতো মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তরুণরা এখন মুঠোফোনকে তাদের শরীরের অঙ্গই মনে করে। ফ্লোরিডা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেছেন, মুঠোফোনে আসক্ত ব্যক্তিদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগে আক্রান্তসহ নানাবিধ জটিল রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। শতকরা ৬৩ শতাংশ মানুষ ঘুম থেকে উঠেই স্মার্টফোনে আগে চোখ রাখেন। অবস্থা এতোই ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে, মুঠোফোনে আসক্তিকে পিসিম্যাগ পেস্নগ রোগের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মোবাইল আসক্তি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা বলেন, সামান্য কিন্তু কার্যকর পরিবর্তন আনা গেলে একাধারে যেমন মুঠোফোন আসক্তি দূর হবে, তেমনি বিষণ্নতার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেও মুক্তি মিলতে পারে। মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তাদের গবেষণার কার্যকর দিক হলো :* নোটিফিকেশন নিয়ন্ত্রণ : মুঠোফোন থেকে অপ্রয়োজনীয় সব নোটিফিকেশন (শব্দ, ব্যানার, ভাইব্রেশন) বাদ দিতে হবে। * সময় নির্ধারণ : কোন অ্যাপ কতক্ষণ ব্যবহার করবেন, এর সময় আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হবে। চাইলে মুঠোফোনের পর্দা চালুর সময় নির্ধারণ করে নিতে পারেন। * ঘুমের সময় মুঠোফোন দূরে রাখুন : অনেকেই ঘুমের সময় মুঠোফোন কাছাকাছি রাখেন। এই অভ্যাস বাদ দিতে হবে। এ জন্য মুঠোফোন সাইলেন্ট বা ভাইব্রেশন বন্ধ করে ঘুমানোর জায়গা থেকে দূরে রাখতে হবে। * মুঠোফোনের পর্দা গ্রেস্কেল : আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে চলা মুঠোফোনে গ্রেস্কেল মোডে সুইচ অন করে রাখতে হবে। পর্দা সাদা-কালো থাকলে মুঠোফোনের আকর্ষণ কমে যায়, ফলে ব্যবহার কম হয়। * সামাজিক যোগাযোগ অ্যাপ লুকানো : যারা ই-মেইল, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের মতো অ্যাপ ব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারছেন না, তারা চাইলে অ্যাপগুলো লুকিয়ে রাখতে পারেন। এ জন্য অ্যাপগুলো মুঠোফোনের হোম স্ক্রিন থেকে সরিয়ে আলাদা ফোল্ডার রাখতে হবে। মুঠোফোন থেকে দূরত্ব বজায় : খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মুঠোফোন দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে মুঠোফোন সাইলেন্ট করে পর্দার দিক নিচে রেখে কাজ করতে হবে। * কঠিন আনলক পদ্ধতি : মুঠোফোনের আনলক পদ্ধতি কঠিন করতে হবে। প্রয়োজনে মুঠোফোনের টাচ আইডি বা ফেস আইডি সুবিধা বন্ধ রাখতে হবে। খোলার পদ্ধতি কঠিন হলে বারবার আনলক করে মুঠোফোন ব্যবহার করতে মন চাইবে না। * উজ্জ্বলতা কমানো : ফোনের ডিসপেস্ন সেটিংস থেকে মুঠোফোনের উজ্জ্বলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখতে হবে। এতে ফোনের নীল আলো কমবে এবং চোখের জন্য উপকার হবে। * মুঠোফোনের কাজ কম্পিউটারে করা : যে কাজ আপনি কম্পিউটারে করতে পারেন, সেগুলো মুঠোফোনে করবেন না। এতে মুঠোফোনের ব্যবহার ও আসক্তি কমবে। * মুঠোফোন রেখে বাইরে : যখন বাইরে যাবেন, প্রয়োজন না হলে সঙ্গে মুঠোফোন নেবেন না। যেমন- কেনাকাটা বা ব্যায়াম করার সময় যতটা সম্ভব মুঠোফোন ঘরে রেখে যাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। এতে ধীরে ধীরে মুঠোফোনের প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। (তথ্য প্রথম আলো) সর্বাধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মোবাইল ফোন আবিষ্কারে মানুষের জীবনযাত্রার মান যতটা বেড়েছে, ঠিক ততটাই অনাচার ও অপরাধ প্রবণতাও বেড়েছে। মোবাইল ফোনের যথাযোগ্য ব্যবহারে যোগাযোগ যতটা সহজ হয়েছে, তেমনি নানা অপকর্ম, কুকর্ম ও নেতিবাচক কাজে জনজীবন হয়ে উঠেছে। আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে অপরাধ প্রবণতাও। বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করে কয়েক মিনিটেই ভয়েস কল, ডাটা কল, সার্কুলেশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। ফলে বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ এবং বিনষ্ট হচ্ছে শৃঙ্খলাও। ছাত্রছাত্রীদের নকল প্রবণতা, উঠতি বয়সিদের যৌন প্রবণতা সবকিছু উপেক্ষা করেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। 'মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা', 'সন্ত্রাসমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ', 'ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া'র আন্দোলনের মতোই মোবাইল আসক্তি মুক্ত করার দাবি সব অভিভাবক, শিক্ষিত ও আত্মসচেতন মানুষসহ সব মহলের হওয়া উচিত অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না। হাসনাইন রিজেন শিক্ষার্থী শম্ভুপুর শাহে আলম মডেল ডিগ্রি কলেজ