বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের দীর্ঘ স্বৈরশাসনে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। অকল্পনীয় দুর্নীতি, দুঃশাসন ও নির্বাহী বিভাগের নগ্ন হস্তক্ষেপে স্থবির হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান। দলীয় ও মুষ্টিমেয় ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দফায় দফায় কাটা-ছেঁড়া করা হয়েছে সংবিধানকে। স্বৈরাচারের হিংস্র থাবায় ধ্বংস হয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী ব্যবস্থা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া। ইতোমধ্যে ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিবর্গ ও সুশীল সমাজ বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন করে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে বিদ্যমান 'ওয়েস্ট মিনিস্টার' ব্যবস্থা এর পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবি তুলছেন তারা।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা 'প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন' (পিআর) সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা- যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। এই পদ্ধতিতে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকবে না। দলীয় আদর্শ দেখে দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন ভোটাররা। এই পদ্ধতিতে একটি রাজনৈতিক দল যত সংখ্যক ভোট পাবে, সেই অনুপাতে জাতীয় সংসদে তারা আসন পাবে। এটিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তে জাতীয় সংসদে আসন বণ্টনের একটি পদ্ধতিও বলা যায়। এই পদ্ধতিতে আসন বণ্টন হলে প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন সম্ভব হয় এবং সংসদে সব দলের ও মানুষের প্রতিনিধি থাকে।
পিআর পদ্ধতিতে আবার তিন ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে- মুক্ত তালিকা, বদ্ধ তালিকা ও মিশ্র ব্যবস্থার নির্বাচন। মুক্ত তালিকায় ভোটের তফসিল ঘোষণার পর দলগুলো প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করে। সংশ্লিষ্ট দল যত ভোট পায় তার হার অনুযায়ী সেই তালিকায় ক্রমানুসারে আসন বণ্টন হয় সংশ্লিষ্ট দলের মধ্যে। বদ্ধ তালিকা পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয় না। আর মিশ্র ব্যবস্থায় কিছু আসনে সংখ্যানুপাতিক ও কিছু আসনে আসন ভিত্তিক নির্বাচন হয়।
পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই পদ্ধতিকেই শ্রেয় বলে মনে করে। ১৮৯৯ সালে বেলজিয়াম এই পদ্ধতিটি প্রথম প্রবর্তন করে। বর্তমান বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৫৪ শতাংশ অর্থাৎ ৯১টি দেশে পিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৫টির মধ্যে ১৮টি, অর্থাৎ ৭২ শতাংশ দেশে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনভুক্ত ৩৬টি উন্নত দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ দেশই আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা অনুসরণ করে। পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা ও নেপাল অনেক আগে থেকেই আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা অনুসরণ করছে।
বাংলাদেশেও বিদ্যমান 'ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট' পদ্ধতির পরিবর্তে 'সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব' ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি অনেক পুরনো। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে সিপিবি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে লিখিত প্রস্তাবে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জানায়। পরবর্তী সময়ে ২০১১ ও ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে সিপিবি ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলসহ কিছু দল এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছিল। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্করণে এবারও তীব্র হয়ে উঠেছে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি। জামায়তে ইসলামীসহ ডানপন্থি, বামপন্থি প্রায় সব রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছে। মূলত পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে, এই পদ্ধতিতে স্বৈরাশাসক হয়ে ওঠার পথ অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোও ভোটের মাঠে ভালো রকমের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে এবং সংসদে শক্ত বিরোধী দল তৈরি হবে। ফলে, দলীয় স্বার্থে বা মুষ্টিমেয় ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সংবিধান কাটা-ছেঁড়ার সুযোগ অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে।
'২৪-এ গণ-অভু্যত্থান ছিল বৈষম্য বিরোধী। রাষ্ট্রের সব স্তর থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করে সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যেই এই গণ-অভু্যত্থান। অর্ধ-শতাব্দি পরে এসে মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বপ্নে আবার সবাই উচ্ছ্বসিত। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা ভোটের মাঠে বড় রকমের বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সর্বশেষ অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারব ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৪০.৮৬ শতাংশ পেয়ে বিএনপি জাতীয় সংসদে আসন পেয়েছিল ১৯৩টি। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৬২টি। কিন্তু দেশে বিদ্যমান ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতির বদলে পিআর পদ্ধতি চালু থাকলে ফল হতো ভিন্ন। এই পদ্ধতিতে ওই নির্বাচনে বিএনপি ১২২টির কাছাকাছি আর আওয়ামী লীগ অন্তত ১২০টি আসন পেত।
আবার ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলোর আসনপ্রাপ্তিতে সামঞ্জস্য ছিল না। ওই নির্বাচনে ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল, অন্যদিকে, বিএনপি ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৩০টি। পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি থাকলে ওই নির্বাচনে বিএনপি পেত অন্তত ৯৭টি আসন এবং আওয়ামী লীগ পেত ১৪৪টি আসন। দেখা যাচ্ছে, বিদ্যমান পদ্ধতিতে ভোটপ্রাপ্তিতে প্রধান দুই দলের মধ্যে তেমন পার্থক্য না থাকলেও সংসদে আসনপ্রাপ্তিতে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। এতে ক্ষমতার কাঠামোতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। কিন্তু পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে সেটি হবে না। সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করে আনুপাতিক নির্বাচন রাজনীতিসহ জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈষম্য কমাবে।
এছাড়াও নির্বাচন জাতীয়ভিত্তিক হওয়ার কারণে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অর্থ, পেশিশক্তি বা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথও বন্ধ হবে। নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম কমে আসবে। প্রার্থীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না বিধায় নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস পাবে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী তালিকায় নিজ অবদানের জন্য জাতীয় পরিচিতি ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন এমন অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করবেন। ফলে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিরা সংসদের সদস্য হবেন। নির্বাচনের পূর্বে বিসদৃশ জোটের পরিবর্তে নির্বাচন পরবর্তী ভোট শক্তির ভিত্তিতে কার্যকর জোট গঠন করা সম্ভব হবে। এছাড়াও ভোটের সমান অনুপাতে আসন বণ্টন হওয়ায় এবং সবার ভোটের মূল্যায়ন হওয়ায়, সবার সমান অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন চিন্তাচেতনার মানুষ সংসদে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে পিআর সিস্টেম।
এই পদ্ধতি নিয়ে বর্তমানে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির মতপার্থক্য রয়েছে। বড় দলগুলো স্বভাবতই এটিকে নিজেদের জন্য ক্ষতির কারণ হিসেবে মনে করবে। কিন্তু অষ্টম এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলটা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে সহজেই এটা অনুমেয় হবে যে, এই পদ্ধতি তাদের জন্য ক্ষতি নয়, বরং সব সময় তারা এই পদ্ধতির সুবিধা পাবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যদি পিআর সিস্টেম চালু না করা হয়, তাহলে পুনরায় বড় দলগুলো অতীতের মতো এটাকে পরবর্তী সময়ে গ্রহণ করবে না। ফলে, বাংলাদেশকে হয়ত আরো একবার স্বৈরাশাসকের সামনে দাঁড়াতে হতে পারে, আবারও হয়ত অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে রক্ত বিসর্জন দেয়া লাগতে পারে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে স্বৈরাশাসনের পথ বন্ধ করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে পিআর পদ্ধতিই একমাত্র সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সমাধান।
বড়দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির পিআর সিস্টেম সম্পর্কে মতপার্থক্যকে সমাধান করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে আমরা বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি তা অনেকাংশেই এগিয়ে যাবে।
সাঈদ মুহাম্মাদ সানোয়ার : কলাম লেখক