শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

জেন জি লেন্সে জাতীয় পার্টির রাজনীতি

গত জুলাই বিপস্নবে শহীদ আবু সাঈদকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে চলার অঙ্গীকার করেছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রংপুর জেলাকে দেশের প্রথমসারির জেলা হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। উত্তর জনপদের মানুষও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং আদর্শিক দৃঢ়তার অভাবে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণের জন্য এখন সময় এসেছে নতুন দিশা খুঁজে বের করার। জেন জি প্রজন্মের উত্থান এবং তাদের বিপস্নবী চেতনা রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিবর্তনের এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এই প্রজন্ম শুধু অতীতের ভুলের সমালোচক নয়; তারা নতুন স্বপ্ন দেখায় এবং উন্নয়নের পথ রচনা করতে চায়।
ড. ইলিয়াছ প্রামাণিক
  ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
জেন জি লেন্সে জাতীয় পার্টির রাজনীতি

জেনারেশন জেড, যার সদস্যদের জন্ম ১৯৯৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে, বর্তমানে তাদের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সদস্যের বয়স ২৮ বছর। এই প্রজন্ম, যাকে 'জেন জি' বা সংক্ষেপে 'এবহ ত' বলা হয়, বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য পস্ন্যাটফর্মে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন জেনারেশন জেড প্রজন্মের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্যদের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ফলে, এই প্রজন্ম তাদের কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত একটি একক দলের শাসনকালে বেড়ে উঠেছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কালে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কৌশলগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী এই বিপস্নবী প্রজন্ম। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই বছরের ৭ মে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও আওয়ামী লীগসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতাচু্যত হওয়ার পর দলটি জাতীয় রাজনীতি থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়ে। বিগত চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে- ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৩৫টি, ১৯৯৬ সালে ৩২টি, ২০০১ সালে ১৪টি ও ২০০৮ সালে ২৭টি আসনে জাতীয় পার্টি নির্বাচিত হয়। এই বিজয়ী আসনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় নব্বই শতাংশ আসনই উত্তরবঙ্গের। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে উত্তরবঙ্গকে জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে ২০২৪ সালের বিপস্নবোত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের এক বড় সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। উত্তর জনপদের বর্তমান রাজনৈতিক চিত্রে নতুন প্রজন্মের উদ্দীপনা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ভবিষ্যতের রাজনীতিকে নতুন দিশা দিতে পারে- যা জাতীয় পার্টির উত্তরাঞ্চলের আধিপত্যকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিজ্ঞান বলে, শিশুর স্মৃতি ঠিক যেন কোমল কুঁড়ির মতো, ৭-৮ বছর বয়স থেকে ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করে। সেই ফুল পূর্ণ রূপে প্রস্ফুটিত হয় ১২ বছর বয়সে, যখন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বা আবেগময় মুহূর্তগুলো মনের গভীরে স্থায়ীভাবে আঁকা হয়ে যায়। তেমনই, জেন জি প্রজন্মের কাছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক দৃশ্যপট যেন তাদের স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধা ছবির মতো। এই সময়কালে জাতীয় পার্টির ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিতে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠিত হলেও জাতীয় পার্টির ভূমিকাকে জাতীয় রাজনীতিতে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সরকারে থাকা সত্ত্বেও দলটি উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। উত্তর জনপদের উন্নয়নে নির্ধারিত দায়িত্বের চেয়ে বরং দলটি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণ এবং উত্তরবঙ্গে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার একটি পস্ন্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে এসেছে।

জেন জি প্রজন্ম আদর্শিক কোনো চর্চার ছাপ জাতীয় পার্টির মধ্যে খুঁজে পায়নি, যার ফলে, দলটি কখনোই ছাত্র রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। তবে উত্তরবঙ্গের এক শ্রেণির বিত্তবান মানুষ সাধারণত সংসদ সদস্য, মেয়র বা চেয়ারম্যান হওয়ার লক্ষ্যে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সফলও হন। যদিও মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি সফলতা অর্জন করেছেন, তবু এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কোনোভাবেই দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের বিরোধীদলবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে তুচ্ছভাবে ব্যবহার করেছে। সেই নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হন- যার মধ্যে জাতীয় পার্টির বেশ কিছু সদস্যও ছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি এমন এক বিতর্কিত অবস্থান নেয়- যা জেন জি প্রজন্ম কখনো ভুলতে পারবে না। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধীদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও দলের তিনজন সংসদ সদস্য মন্ত্রিসভায় স্থান পান। বিরোধীদলের নাম থাকলেও, দলটিকে সব সময় সরকারে পালস বুঝে চলতে হয়েছে, যার ফলে, দেশবাসী তাদের গৃহপালিত বিরোধীদল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। একাদশ ও দ্বাদশ সংসদেও জাতীয় পার্টি বিরোধীদলের ভূমিকায় ছিল। জেন জি প্রজন্ম সরাসরি বাংলাদেশের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন (দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ) প্রত্যক্ষ করেছে- যা তাদের স্মৃতিতে গভীরভাবে আঁকা রয়ে গেছে।

জেন জি প্রজন্ম ইতিহাসের পাতায় নয়, বরং নিজেদের অভিজ্ঞতায় তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তারা কখনো ভোটাধিকার প্রয়োগের আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। এই বঞ্চনার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেমন দায়ী, তেমনি জাতীয় পার্টিও কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। জাতীয় পার্টি বরাবরই দাবি করেছে যে, তারা পরিস্থিতির শিকার, কিন্তু পরিস্থিতিকে দোষারোপ করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা কতটা যৌক্তিক? ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচনে অংশ না নিত, তাহলে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হয়তো ভিন্ন হতে পারত। তবে আদর্শিক কোনো দৃঢ় অবস্থান জাতীয় পার্টি কখনো নিতে পারেনি, বরং তারা সব সময় পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল থেকেছে। এমন নীতিহীন অবস্থান কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য কাম্য নয়। জাতীয় রাজনীতিতে উত্তরবঙ্গকে প্রধানত জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু দলটির এই দুর্বল অবস্থানই এখন এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পার্টির বিগত দিনের ভূমিকার কারণে জেন জি প্রজন্ম কোনোভাবেই তাদের নির্দোষ বলে মানতে পারছে না। ফলে, এই বিপস্নবী প্রজন্মের কাছে দলটি যৌক্তিকভাবে গুরুত্ব হারিয়েছে। জুলাই-আগস্টের অভু্যত্থানে ছাত্রনেতৃত্বের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এবারের সংলাপে জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা মোটেও সমীচীন নয়। এই বিপস্নবী প্রজন্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদের শব্দ চয়নে সতর্ক থাকা জরুরি।

২৬ অক্টোবর রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম বীরের বেশে উপস্থিত হন। সন্ধ্যায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে 'রাষ্ট্র পুনর্গঠনে তারুণ্যের ভাবনা' শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এক উদ্দীপনাময় বক্তব্য প্রদান করেন- যা উপস্থিত সবার মধ্যে উদ্দীপনার সঞ্চার করে। পরে তিনি শিক্ষার্থীদের একটি মিছিলে যোগ দেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সারজিস আলমকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাগত জানান। রংপুরের আপামর জনসাধারণও তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান আবু সাঈদের রক্তমাখা রংপুর শহরে। জাতীয় পার্টিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে সারজিস, নাহিদ ও আক্তারের মতো তরুণ নেতৃত্ব এ প্রজন্মের জন্য একটি আলোকবর্তিকা- যা সারা দেশের তারুণ্যের গৌরব। কারণ এই প্রজন্মই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছে এবং রাষ্ট্রের সংস্কারের স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমরা উত্তরবঙ্গকে আবারও পিছিয়ে পড়তে দেখতে চাই না। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা চাই ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো যেন পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল না থেকে আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

গত জুলাই বিপস্নবে শহীদ আবু সাঈদকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে চলার অঙ্গীকার করেছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রংপুর জেলাকে দেশের প্রথমসারির জেলা হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। উত্তর জনপদের মানুষও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং আদর্শিক দৃঢ়তার অভাবে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণের জন্য এখন সময় এসেছে নতুন দিশা খুঁজে বের করার। জেন জি প্রজন্মের উত্থান এবং তাদের বিপস্নবী চেতনা রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিবর্তনের এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এই প্রজন্ম শুধু অতীতের ভুলের সমালোচক নয়; তারা নতুন স্বপ্ন দেখায় এবং উন্নয়নের পথ রচনা করতে চায়।

ড. ইলিয়াছ প্রামাণিক : ছাত্র উপদেষ্টা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে