বিপস্নব ও সংহতি দিবসের তাৎপর্য

আজ আবারো ৭ নভেম্বরের চেতনাকে লালন করে শোষণ, নিপীড়ন থেকে মুক্তি এবং একটি সুশাসনভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে।

প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শেখ রিফাদ মাহমুদ
জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস তথা ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন, যাকে আমরা বিপস্নব ও অনুপ্রেরণার দিন হিসেবে স্মরণ করি। দিনটিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য দেশের জনগণ ও সিপাহীরা এক হয়ে শত্রম্নদের ষড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছিল। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জাতি এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা, ষড়যন্ত্র ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বরের সামরিক অভু্যত্থান এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হলে সৃষ্ট পরিস্থিতি জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ৬ নভেম্বর গভীর রাতে, প্রায় ১টার সময়, সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিপক্ষে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপস্নবের স্ফুরণ ঘটায়। ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বিপস্নবী সিপাহীরা উদ্ধার করে আনেন মেজর জেনারেল জিয়াকে। এই ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার অভু্যত্থানের মাধ্যমেই ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়। ৭ নভেম্বর (শুক্রবার) ভোরে রেডিওর তরঙ্গে ভেসে আসে তার কণ্ঠস্বর, 'আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।' সে সময় তিনি জাতির উদ্দেশে শান্তির বার্তা দিয়ে সবার প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। সেই দিন ঢাকার রাজপথ পরিণত হয় জনতার মিছিলে। পথে পথে সিপাহী ও জনতা একে অপরকে আলিঙ্গন করে, 'নারায়ে তাকবির আলস্নাহু আকবর' এবং 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো ঢাকা শহর। এই সিপাহী-জনতার সম্মিলিত বিপস্নব সমস্ত ষড়যন্ত্র ভন্ডুল করে দেয়। আনন্দে উদ্বেলিত হাজারো মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সাধারণ জনতা ট্যাঙ্কের নলে ফুলের মালা পরিয়ে তাদের শুভেচ্ছা জানায়। এই বিপস্নবের আনন্দময় ঢেউ রাজধানী পেরিয়ে দেশের শহর-নগর-গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। বিপস্নবের পর তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটিয়ে দেশের অগ্রগতির পথে এক অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হন। জিয়াউর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। একনায়কতন্ত্র ব্যবস্থার কালো দর্শন সরিয়ে সূচনা হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের, যেখানে রাজনৈতিক দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। দেশে ফিরে আসে আইনের শাসন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা দুমড়েমুচড়ে দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরে আসে। দেশের মানুষের জন্য একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়- যা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সার্বিক উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করে। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত ও অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্যিক খাতে বৈপস্নবিক পরিবর্তন আনেন। দেশের মানুষের জন্য জীবনমান উন্নত করতে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর দেন। তার শাসনামলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের সম্মানজনক অবস্থান তৈরি হয়। দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা লাভ করে এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়। তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা 'সার্ক'র-এর স্বপ্নদ্রষ্টাও ছিলেন তিনি। এই দিনটি শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বরং আমাদের জাতীয় জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ৭ নভেম্বরের বিপস্নব আমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিপস্নব শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, এটি ছিল দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য একটি দৃঢ় পদক্ষেপ। ৭ নভেম্বরের বিপস্নব বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং দায়িত্ববোধ সঞ্চার করেছিল। এই বিপস্নবের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ স্বাধীনতার চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এবং সবাই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে একত্রে কাজ করার সংকল্প গ্রহণ করে। জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে সিপাহী-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে সংকট থেকে রক্ষা করেছিল। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশের মানুষের উন্নয়ন এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ হিসেবে এ বিপস্নব আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। তার দর্শন এবং নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে গিয়েছিল। ৭ নভেম্বর বিপস্নবের সবচেয়ে বড় অর্জন এক দক্ষ এবং প্রজ্ঞাবান নেতা জিয়াউর রহমানের অভু্যদয়, যিনি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন সেই সাহসী, দূরদর্শী নেতা, যিনি একাত্তরের ক্রান্তিকালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিকচিহ্নহীন জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহস যুগিয়েছিলেন, অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। আজ আবারো ৭ নভেম্বরের চেতনাকে লালন করে শোষণ, নিপীড়ন থেকে মুক্তি এবং একটি সুশাসনভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের দেশের জন্য জিয়াউর রহমানের দর্শন এবং জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবসের তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। জাতীয় বিপস্নব ও সংহতি দিবসের চেতনার মূল লক্ষ্যই হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল জনগণের মাঝে পৌঁছে দেওয়া এবং অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে সবাই মিলে শান্তিশৃঙ্খলা, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে একটি উন্নত সমাজ গড়ে তোলা। শেখ রিফাদ মাহমুদ : চেয়ারম্যান, এসআরআই ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন উপদেষ্টা, গেস্নাবাল স্টুডেন্ট ফোরাম