শিশু থেকে বৃদ্ধ বনিতা সবারই বহুল পরিচিত প্রবাদ 'শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড'। একটি জাতির এগিয়ে চলার, বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মূলভিত্তি গড়ে দেয় শিক্ষা। একটি জাতি কতটা সভ্য ও উন্নত তার মানদন্ড ঠিক করে দেয় শিক্ষা। আর জাতি গড়ার এই কাজটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে, সুনিপুণভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। বয়স ও মানসিক বিকাশ বিবেচনায় স্নাতক পর্যায়ে তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একজন মানুষ শিক্ষার পরিপূর্ণ স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ লাভ করেন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান সাধনার তীর্থক্ষেত্র। আধুনিক কালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত ইউরোপীয় ধাঁচে নির্মিত। তবে ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ইউরোপেরও বহু আগে ভারতীয় উপমহাদেশে নালন্দা, বিক্রমশীলা ও তক্ষশীলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায়, তাদের উদ্ভব হয়েছিল ভারতীয় চিত্তের আন্তরিক প্রেরণায় এবং স্বভাবের অনিবার্য আবেগে।
এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, রূপরেখা, পাঠ্যসূচি এবং নিয়ম-কানুনের ক্ষেত্রে ইউরোপ কিংবা প্রাচীন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এই বাস্তবতা মেনেও বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার নিমিত্তে এ যাবৎ কালে দেশে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতক ছাড়িয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানোন্নয়নে, যুগোপযোগী পাঠ্যসূচি নির্ধারণে, গবেষণা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বহুদূর পিছিয়ে রয়েছে।
প্রতিবছর শিক্ষা ও গবেষণার আন্তর্জাতিক মানদন্ডের ভিত্তিতে প্রকাশিত তালিকায় আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সামনের সারিতে খুঁজে পাওয়া যায় না, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। এর কারণ, যে যে সূচকের ওপর ভিত্তি করে এইর্ যাংকিং প্রকাশ করা হয়, তাতে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী নেই। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ সীমিত। তাছাড়া, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদানে অভিজ্ঞ এমন শিক্ষকের অভাব এবং যুগোপযোগী পাঠ্যসূচি না থাকায় শিটভিত্তিক মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে জ্ঞানার্জন করা ও সৃষ্টিশীল কাজে আত্মনিয়োগ করার, তা ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নেই। বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই সমস্যাটি প্রকট। ক্লাসরুমের সংকট, ল্যাব রুম সংকট, ইন্টারনেট ও পাঠদান সংক্রান্ত প্রযুক্তির অপ্রতুলতা শিক্ষার্থীদের গুণগত মানের শিক্ষা অর্জনে বাঁধা প্রধান করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সুবিধার সংকট এবং সেশনজট এই সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। তাছাড়া পঠিত বিষয়ের সঙ্গে পরবর্তী পেশা জীবনের মিল না থাকা কিংবা পেশাগত জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সুযোগ না থাকায়, তা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় উদ্বেগ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিহিংসাপরায়ণ লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দলীয় কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করানো,র্ যাগিং কালচার, টর্চার সেল সংস্কৃতি, অবৈধভাবে হলের সিট দখল করা, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনের সুন্দর ও নির্মল পরিবেশকে এক ত্রাসের রাজত্বে পরিণত করে, যা গুণগত মানের শিক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে অভূতপূর্ব ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রুগ্ন দশা কাটিয়ে ওঠার জন্য যথাযথ উদ্যোগ করা সময়ের সবচেয়ে উপযুক্ত দাবিতে পরিণত হয়েছে। এজন্য সরকারকে আন্তরিক সদিচ্ছার সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষক নিয়োগে মেধার মূল্যায়ন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অপরাজনীতি দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে এই পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যার জন্য সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
মো. রমজান মিয়া
শিক্ষার্থী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়