নবান্ন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্য উৎসব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন নবান্ন। এ দেশের কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন এর মধ্যে অন্যতম। 'নবান্ন' শব্দের অর্থ 'নতুন অন্ন'। হেমন্তে নতুন আমন ধান ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অগ্র অর্থ 'প্রথম'। আর 'হায়ণ ' অর্থ মাস। এ থেকে সহজে ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। হাজার বছরের পুরনো এই উৎসব সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম, যা বাঙালির সঙ্গে চিরবন্ধনযুক্ত।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ মাস তথা হেমন্ত ঋতু আসে নতুন ফসলের সওগাত নিয়ে। কৃষককে উপহার দেয় সোনালি দিন। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনালি ধানের সগৌরবে বুকে ধারণ করে হেসে ওঠে বাংলাদেশ। তাই বিপুল বিস্ময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গেয়ে ওঠেন 'ওমা ফাগুনে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।' হাসি ফোটে কৃষকের মুখেও; মাঠভরা সোনালি ফসল নতুন স্বপ্ন জাগায় চোখে। পলস্নীকবি জসিম উদ্দীন হেমন্তে মাঠভরা ফসলের সম্ভারে মুগ্ধ হয়ে 'নক্সীকাঁথার মাঠ' কবিতায় বলেন, 'আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান, সারা মাঠ ভরি গাহিছে যে যেন হলদি-কোটার গান। ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়, কলমীলতার দোলন লেগেছে, হোসে কূল নাহি পায়।'
মূলত বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব পালিত হয় আমন ধানের ফলন ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে।
কারণ, এটিই ছিল একসময় নিশ্চিত ফসল। আমন ধান 'আগুনি ধান' বা 'হৈমন্তিক' ধান নামেও পরিচিত। আবহমান কাল থেকে এই ধানেই কৃষকের গোলা ভরে, যা দিয়ে কৃষক তার পরিবারের ভরণ-পোষণ, পিঠাপুলি ও আতিথেয়তাসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাত। এজন্যই হয়ত এই মৌসুমকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব।
প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির জীবনে অগ্রহায়ণ কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে। কৃষকের মাঠে তখন সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। অগ্রহায়ণ এলেই কৃষকের মাঠজুড়ে আমন ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। তাই তো কবি আহসাব তার নতুন ধান কবিতায় লিখেছেন 'কাস্তে হাতে চলছে কৃষক/মাঠে নতুন ধান/নতুন ধানের গন্ধে তাহার/ভরে উঠে প্রাণ।' কৃষক রাশি রাশি সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরে। কৃষাণ-কৃষাণির প্রাণমন ভরে ওঠে এক অলৌকিক আনন্দে। এ সময় নতুন ধান ঘরে ওঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন কৃষাণ-কৃষাণিরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ সময় কৃষাণিরা নতুন ধানের চাল থেকে ফিরনি, পায়েশ, পিঠা-পিটুলি তৈরি করে আত্মীয়স্বজন নিয়ে তা পরমানন্দে ভোগ করে এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য, যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। এরপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া-দাওয়ার ধুম।' নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় এক সামাজিক মেলবন্ধনের, গড়ে ওঠে পারস্পরিক সৌহার্দ্য।
হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। নতুন ফসল ঘরে ওঠার আনন্দ। নতুন ধানের আগমণে কৃষকের ঘরে ঘরে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। তাই কবির বন্দনা 'আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা গেঁথেছি শেফালী মালা/নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে/সাজিয়েছি ডালা।' জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় নতুন আমন ধানের আঘ্রাণে অগ্রহায়ণকে মাৎ করে দেওয়ার কথা উচ্চারিত হয়েছে এভাবে 'ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এল কি ধরনীর সওগাত? নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ'। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ।
আমাদের দেশে নবান্ন উৎসবে অঞ্চল ভেদে চলে জারি, সারি, মুর্শিদি, লালন, পালা ও বিচার গান। ছোটদের বাড়তি আনন্দ দিতে মেলায় আসে নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপ। তখন হয়ত মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দূর অতীতের কথা, যেখানে মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাই একসঙ্গে মিলে নবান্নের উৎসব উপভোগ করত।
নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলার ঐতিহ্যগুলো ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। আজকের গ্রামবাংলার শিশুরা যেন স্বপ্নের মধ্যে নবান্নের উৎসবের ইতিকথা বাবা-মা, কিংবা দাদা-দাদির মুখে মুখে শোনে। অন্যদিকে খেলার মাঠের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ডিজিটাল যুগে খেলার জায়গা বলতে একচিলতে বারান্দা। শিশুদের খেলার মাঠের জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্যাব, মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের ছোট্ট মনিটর। দুরন্ত শৈশবটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের। নগরায়ণ আর আধুনিকতার অজুহাতে বিলীন হচ্ছে সব ঐতিহ্য। তেমনি গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে, কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। এমন করে নীরবে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে। বস্তুত নবান্ন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী উৎসব। নবান্ন এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এই উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। তাই নবান্ন উৎসবের গুরুত্ব অপরসীম।
সুদীর্ঘকাল থেকেই কৃষি আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই আমাদের বাঁচতে হলে 'কৃষি বিপস্নব' সফল করেই বাঁচতে হবে। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বিস্ময়কর ও অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে কৃষি খাত থেকে। তাই বলতে হয়-কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে আমরা পরিজন-পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারব।
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। এ দেশে বছরের বিভিন্ন মৌসুমে আউশ, রোপা আমন, বোরো ও বোনা আমন ধানের চাষ হয়ে থাকে। ধানকে এ দেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে ভাত থেকে। তাই খাদ্য বলতে আমরা প্রধানত ভাতকেই বুঝে থাকি। বস্তুত ভাতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের নাড়ির টান। এ দেশের আবাদি জমির শতকরা ৭৫-৮০ ভাগই ধানের চাষ হয়ে থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি আজ হুমকির মুখে। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে কৃষক যদি তার ক্ষেতে সোনালি ফসলের মধুর হাসি দেখতে চান, তবে তাকে করতে হবে কঠোর পরিশ্রম এবং প্রয়োগ করতে হবে সঠিক ও উন্নত প্রযুক্তি। বর্তমান পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া কৃষিকাজেও প্রভাব ফেলছে, যা আমাদের জন্য সুখবর।
'নতুন ধানে, নতুন প্রাণে' বাঙালির ঘর ভরে উঠুক নবান্নের উৎসবে'। সবার মনপ্রাণের সেই কথা আবারও বলতে ইচ্ছা করছে। 'গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান।' আমরা জানি না উলিস্নখিত বাক্যগুলোর বাস্তব অর্থে ফিরে আসতে পারব কিনা। তবে বাংলার ওই ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা যদি এগিয়ে আসি, কিছুটা হলেও ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারব। 'মাস্ক ব্যবহার করুন, সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।' সবার অনাগত দিনগুলো নবান্ন উৎসবে মুখরিত হয়ে আগামীর পথে চলব আমরা।
শতদল বড়ুয়া
চট্টগ্রাম