আলোকিত সমাজ গঠনের মূলমন্ত্র গ্রন্থপাঠ
বই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, আলোকিত জীবনের উপকরণ। বইপড়া ছাড়া কেউ জ্ঞানী হতে পারে না। জগতে শিক্ষার আলো, নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব জ্ঞানের প্রতীক বইয়ের মধ্যে নিহিত। তাই যে ব্যক্তি যত বেশি বই পড়বে, সে ব্যক্তি তত বেশি জ্ঞানী।
প্রকাশ | ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
জিন্নাতুন নেসা শান্তা
পবিত্র আল কুরআনের প্রথম বাণী 'ইকরা' অর্থ- পড়ুন। আর পড়ার মাধ্যম হচ্ছে বই। বইয়ের পাতায় শোনা যায় জ্ঞানের মহাসমুদ্রের কলেস্নাল ধ্বনি। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি সব বিষয়ে জানা যায় বই পড়ার মাধ্যমে। বই পাঠকের মনকে করে উদার, দৃষ্টি করে উন্নত, জীবনকে চালিত করে সত্যের পথে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে আলোকিত করে ভুবন। বই জ্ঞানের প্রতীক, আনন্দের প্রতীক। একটি ভালো বই জীবনের দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-অবসাদ থেকে মুক্তি দিতে পারে। পারে নিজের সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে। বই মানুষকে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, জাতীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে সততা, নৈতিকতা, চরিত্রবান, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, আদর্শের আলো জীবনে প্রজ্বলন করে দিতে পারে। জাগ্রত করতে পারে ঘুমন্ত বিবেক। বই জ্ঞানের আধার। তাই তো পৃথিবীর বিখ্যাত মনীষী, সফল ব্যক্তিবর্গ বেশি বেশি বই পড়তেন। বই পড়ার কারণে তাদের চিন্তাচেতনা হতো মহৎ, কর্মকান্ড হতো উন্নত। বই পড়ে সুশৃঙ্খল ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষ হয়ে ওঠে কর্মোদ্যম, সহনশীল ও সহমর্মী। তার মানবিক সুকোমল বৃত্তিগুলো বিকশিত করে তাকে দায়িত্বসচেতন, দেশপ্রেমিক ও বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিকে পরিণত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'বই অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে'। বই পড়ার মাধ্যমে আমরা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারি। ইতিহাসে সংঘটিত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন ও সমাজ পরিচালনা করলে পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সঠিকভাবে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। তেমনই ভাবে বর্তমান ঘটনাগুলো গ্রন্থের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো যাবে। এছাড়াও বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়ে আমরা বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন আবিষ্কার ( যেমন: রোবটিক্স, এআই, থ্রিডি, ফোরডি, জেট-বিমান ইত্যাদি ) সম্পর্কে জানতে পারি এবং তাদের নিত্যনতুন আবিষ্কারের প্রতি আগ্রহী হতে পারি। জানতে পারি মহাকাশের অজানা গ্রহ, উপগ্রহ, ছায়াপথ সম্পর্কে। যা আমাদের আকৃষ্ট করে মহাকাশে পাড়ি দিয়ে নতুন কিছু আবিষ্কারে। এছাড়াও সমাজের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদির মতো মারাত্মক সমস্যা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তাও আমরা বই থেকে ধারণা লাভ করতে পারি। সমাধান করতে পারি গণিতের কঠিন কঠিন ইকুয়েশন, জানতে পারি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রত্তর অণুজীব সম্পর্কে, জৈব রসায়নের নিত্যনতুন ক্রিয়া বিক্রিয়ার কথা। আর সাহিত্য প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা কয়। প্রাণে প্রাণে প্রেরণা ছোটায়। মন খারাপে অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কাজ করে গল্প, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, সায়েন্স ফিকশন, কল্পকাহিনী, থ্রিলার ইত্যাদি। ছোটবেলায় ঈশপের গল্প থেকে শুরু করে পথের পাঁচালী, অপরাজিত, সোনার তরীর, সাতকাহন, বিদ্রোহী, পথের দাবি, আরেক ফাল্গুন ইত্যাদির মতো বইগুলো বাস্তবতার সামাজিক প্রেক্ষাপটের চিত্র দেখায়- যা থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যক্তিগত জীবন ও সমাজ জীবন সুন্দর এবং উন্নত করা যায়। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক লেখাপড়ার চাপে ও নানা অজুহাতে অন্যান্য বই পড়া থেকে বিরত থাকছে। অভিভাবকরাও একাডেমিক বইয়ের বাহিরে বই পড়তে উৎসাহিত না করায় তাদের মেধা, চিন্তাশক্তি যথাযথ বিকশিত হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা আটকে পড়ছে ফ্রি ফায়ার, পাবজি, ফেসবুক, ফিল্টার, টিকটক ইত্যাদির মতো মরিচিকায়। তাছাড়াও মাদকাসক্ত, কিশোর গ্যাং, নারী নির্যাতন, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ফলস্বরূপ নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ হারিয়ে তাদের ব্যক্তিগত জীবন ধ্বংসের পাশাপাশি সমাজের সুন্দর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
\হবই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, আলোকিত জীবনের উপকরণ। বইপড়া ছাড়া কেউ জ্ঞানী হতে পারে না। জগতে শিক্ষার আলো, নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব জ্ঞানের প্রতীক বইয়ের মধ্যে নিহিত। তাই যে ব্যক্তি যত বেশি বই পড়বে, সে ব্যক্তি তত বেশি জ্ঞানী।
সে তত বেশি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে পারবে নিজকে এবং সমাজকে। দেশকে উপস্থাপন করতে পারবে বিশ্বের দরবারে। প্রত্যেকটা ধর্মের রয়েছে নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ। আর সে ধর্ম গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে আদর্শ জীবনযাপন করা যায়, সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা মানুষকে ধর্মভীরু ও মহৎ প্রাণ করে তোলে, চিত্ত মানবাত্মাকে জীবনবোধে বিকশিত করে। তাই উন্নত দেশের মানুষ কাজের ফাঁকে একটু সময় পেলেই বই পড়ে। কিছু মানুষ বই কেনাকে অপচয় মনে করে। প্রকৃতপক্ষে বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। বরং একটি বই একশটি বন্ধুর সমান। গ্রন্থাগার ভাবের মিলন-সেতু। মানুষের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা গ্রন্থাগারে বন্দি থাকে। এখানে চিন্তাবিদ পায় তার নানামুখী চিন্তার খোরাক এবং নানা দুরূহ জিজ্ঞাসার উত্তর, ভাবুক পায় ভাব রসের সন্ধান। বই মনের খাদ্য জোগায়। মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সব সমস্যার সমাধান বইয়ে পাওয়া যায়। বইয়ের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। উন্নত চিন্তাধারার অধিকারী হতে পারি। বই পড়ে মানুষ সুনাগরিক হতে পারে। বই পড়ার মাধ্যমে ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায়, বিবেক বোধ জাগ্রত হয়, ভালো-মন্দের তফাৎ বোঝা যায়, উন্নত-অনুন্নতের পার্থক্য দৃশ্যমান হয়। এসব পার্থক্য যখন একটা মানুষ বুঝতে পারে তার দ্বারা সমাজের উন্নতি অবধারিত।
\হযেহেতু একজন জ্ঞানী মানুষের দ্বারাই সমাজের ভালো, উন্নয়ন সম্ভব। তাই দেশকে উন্নত ও সমাজকে সুন্দর করতে চাইলে শিক্ষার্থীদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। একাডেমিক বই এর পড়া মুখস্থভিত্তিক না করে মজার ছলে, ব্যবহারিক কৌশলে শেখালে শিক্ষার্থীদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে এবং পরিবারের সদস্যরা ছোট বেলা থেকে একাডেমিক বই এর পাশাপাশি বাচ্চাদের নানারকম রংবেরঙের গল্প, ছড়ার বই কিনে দিয়ে, নিজেরা পড়ে শুনিয়ে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারি। তাহলে, একটা বাচ্চার মস্তিষ্কের যথাযথভাবে বিকশিত হবে, উন্নত চিন্তাভাবনা করতে পারবে। পাশাপাশি উপহার স্বরুপ বই দিয়েও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা যেতে পারে। বই পড়ার মাধ্যমে নিজেরা সুনাগরিক হয়ে, পরিবর্তিতে সমাজকে আলোকিত ভোরে রূপান্তরিত করা যাবে। দেশকে উপস্থাপন করা যাবে বিশ্বে দরবারে। তাই বেশি বেশি বই পড়ি, আলোকিত সমাজ গড়ি।
জিন্নাতুন নেসা শান্তা : লেখক