১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্রের জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং পরবর্তী সময়ে লুপ্ত লীগ অব নেশন্সের স্থলাভিষিক্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৯৩টি দেশ ও দুইটি পর্যবেক্ষণকারী দেশ জাতিসংঘের সদস্য। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ১৩৬তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত হয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- শান্তি ভঙ্গের হুমকি ও আক্রমণাত্মক প্রবণতা ও কার্যকলাপ দূর করে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; সব মানুষের সমান অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব জোরদার করা; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পুরো জাতির মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলা; জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধবোধ গড়ে তোলা; আন্তর্জাতিক আইনের সাহায্যে আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা; প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের স্বীকৃতি এবং তা সমুন্নত রাখা এবং উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের কার্যধারা অনুসরণ করা।
১৯৪৫ সালে শক্তিধর দেশের উদ্যোগে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠাকালে সারা বিশ্বের মানুষ ও অধিকাংশ দেশগুলো এটাকে সমর্থন দিয়েছিল। সবার প্রত্যাশা ছিল একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। হানাহানি, যুদ্ধ, ধ্বংস শেষ করে এবার বিশ্বে শান্তি বিরাজ করবে। সারা বিশ্বে এবার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের যে স্থায়ী সদস্য দেশগুলো ছিল তাদের ওপর সবার প্রত্যাশা ছিল বেশি। তারা পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং পাশাপাশি অন্য ক্ষুদ্র বা অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোকেও সহায়তা করবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য দূর হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। অনেকে বলেন, জাতিসংঘ তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পালনে অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। প্রথমত, জাতিসংঘ উপনিবেশবাদের সমাপ্তি ঘোষণা করতে পেরেছে। রাষ্ট্রগুলোকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব দান করতে জাতিসংঘের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। ষাটের দশকে এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের জাতীয়তাবাদের মুক্তিসংগ্রামকে জাতিসংঘ সহায়তা করেছে। যেসব জনগোষ্ঠী নিজেদের ভূখন্ড, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, সেগুলোকে জাতিসংঘ নির্বিঘ্নে সহায়তা করেছে। ফলে, উপনিবেশবাদ থেকে বিশ্ব মুক্ত হয়েছে। অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের এই উদ্যোগ অনেক বেশি ইতিবাচক ও সার্বজনীন।
জাতিসংঘ কর্তৃক শান্তিরক্ষা মিশন জাতিসংঘের একটি বড় সফলতা। শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ যুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলোকে সহায়তা করছে, বিভিন্ন আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমনে সেই রাষ্ট্রগুলোকে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা সহায়তা করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষায় সর্বদা উদ্যোগী, সর্ব অবস্থায় শান্তির পক্ষে ও শান্তিরক্ষাকে বাংলাদেশ মৌলিক কাজ বলে মনে করে। জাতিসংঘের এই মিশনে বাংলাদেশের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাংলাদেশ সুষ্ঠুভাবে পালন করছে। অন্যদিকে, বলা যায়, জাতিসংঘও শান্তিরক্ষা মিশনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব শান্তিরক্ষা- যা তার মৌলিক কাজ তা পালন করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার এ কথাগুলো বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। তবে এটাও বলে রাখা দরকার যে, এই কার্যক্রম সব সময় নির্বিঘ্ন থাকেনি। অনেক সময়ই এ কাজ নিয়ে প্রশ্ন এসেছে। তারা সবাই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, এটা জাতিসংঘের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। যদিও এখনো শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম চলমান। আমরা চাই আস্তে আস্তে এই কার্যক্রম কমে আসুক। সারা বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। যদিও এখন পর্যন্ত এই বাহিনী রাখার যৌক্তিকতা আছে।
তবে বর্তমান বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং হিরোশিমা ও নাগাসাকি পৃথিবীর মানুষের কাছে নৃশংসতম বর্বরতার একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে বছরের পর বছর ধরে চিত্রিত হয়ে আসছে। হিরোশিমা ও নাগাসাকির নাম শুনলেই বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের মন ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। অথচ এর চির অবসান হওয়া দরকার। এ জন্য প্রয়োজন সব দেশের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ পারমাণবিক অস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে তুলবে, পৃথিবীকে তটস্ত রাখবে আর কেউ এর অধিকারীও হতে পারবে না- তাতো কোনো আইন হতে পারে না। এজন্য বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিধর দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব পরিহার করতে হবে।
এ কারণে জাতিসংঘকে অনেকেই কাগুজে বাঘ বলে থাকে কারণ জাতিসংঘের অনেক কার্যাবলি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পঞ্চভূত বা পাঁচটি স্থায়ী সদস্যদের ভেটো পাওয়ারের কাছে অসহায় ও সীমাবদ্ধ। পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের স্বার্থের বাইরে জাতিসংঘ কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারে না। প্রতিটি স্থায়ী সদস্য পারমাণবিক শক্তির অধিকারী এবং তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিশ্বে অনেক কিছু সংঘটিত হয়। তাদের অঙ্গুলি নির্দেশে বিশ্বের কূটনীতি ও রাজনীতি আবর্তিত হয়। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের জ্বলন্ত প্রমাণ। তাছাড়া, জাতিসংঘ মূলত বৃহৎ শক্তিধর দেশের চাঁদায় পরিচালিত এবং কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চাঁদা দানকারী দেশগুলোও মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ অনেক সময় বৃহৎ পাঁচ স্থায়ী সদস্যের কাছে অসহায় বোধ করে।
পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার ও সুবিধা থেকে এসব মানুষ বঞ্চিত। অথচ মানব জাতিকে ধ্বংসের জন্য উন্নত দেশসমূহ মরণাস্ত্র তৈরির পেছনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এসব না করে উন্নত দেশের নেতারা আজ যদি তাদের সময়, শ্রম এবং অর্থকে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, মরণব্যাধি এইডস এবং করোনা মহামারি নির্মূলের জন্য ব্যয় করত তাহলেই বরং বিশ্ববাসী উপকৃত হতো এবং শান্তি পেত। মারণাস্ত্র তৈরির জন্য যেই বাজেট ব্যয় হচ্ছে, সেই বাজেটের সিকি ভাগও যদি আজ মানব জাতির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য ব্যয় হতো তাহলে পৃথিবী আজ ক্ষুধা এবং দরিদ্রতামুক্ত হতো। আর এটাই হতো সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চা।
তবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রগুলোর যে চরিত্র ছিল, তা এখন দৃশ্যতই অনেকটা পাল্টে গেছে। আগে রাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেহারা ছিল আন্তঃরাষ্ট্রীয়, এখন এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের সংঘাত। বর্তমানে এমন সংঘাতের চেহারা পাল্টে গেছে বা বলা চলে নতুন রূপ পেয়েছে। বিশেষ করে পরিবর্তিত বিশ্ব এই প্রেক্ষাপট তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেয়ে বড় বিপদের কারণ হয়েছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংঘাত। বাইরের রাষ্ট্র এসে আক্রমণ করছে না। কিন্তু রাষ্ট্রের নিজের ভেতরেই যে সংঘাত, দ্বন্দ্ব তাই তাকে সামগ্রিক সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর অবস্থা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। যেমন কঙ্গো, সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট, সুদান ছাড়াও আরও কিছু নতুন দেশ যেমন ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের ঘটনা। বর্তমানে সব দেশই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতে ভুগছে। ফলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেয়ে এখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত তীব্র হচ্ছে। রূপান্তর ঘটেছে, বদলে যাচ্ছে সংঘাত ও সংগ্রামের চিত্র। খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সংঘাতের এই চেহারা দিন দিন বেশ জটিল হচ্ছে।
যদিও জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত সুরাহা করার জন্যও সে প্রস্তুত। কিন্তু তাতে খুব বিশেষ সফলতা দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় কয়েক বছর ধরে যে ধরনের সংঘাত বিরাজ করছে, তা আমাদের মনে শঙ্কার জন্ম দেয়।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিনিদের একক আধিপত্য এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে। আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের পুনঃজাগরণ ও পরাশক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াজুড়ে তাদের একক আধিপত্য তৈরি, ন্যাটো সামরিক জোটের সম্প্রসারণ, ইউরোপের রাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার এবং এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে আর্থসামাজিক উন্নয়নের অংশীদারিত্বের নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, সাবেক যুগোস্স্নাভিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেটা এখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বিপুল সম্পদ নষ্ট ও লাখ লাখ মানুষের মৃতু্য লুটপাট ও জনপদ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। কোটি মানুষ দেশান্তর ও গৃহহীন হয়েছে। বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার পথে এখন ভারত, চীন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি সৌদি আরব, মেক্সিকো, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম রাশিয়ার বিরুদ্ধে একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে মানছে না, বিশ্বরাজনীতির গতি প্রকৃতিতে ও নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভেনেজুয়েলা, সিরিয়া ও কিউবা মার্কিন এবং পশ্চিমা শক্তির তথা ন্যাটো জোটের বিপরীতে। দুই পরাশক্তির ভারসাম্য ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের মাঝে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তি বিনির্মাণ প্রক্রিয়া ঝুলে রয়েছে। অনেকে বলেন, জাতিসংঘ পঞ্চশক্তির ভেটো পাওয়ারের কাছে অনেকটা জিম্মি এবং এ ধরনের সংঘাতে পঞ্চশক্তির বাইরে গিয়ে জাতিসংঘ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ফলে, জাতিসংঘ অনেক ক্ষেত্রে সফলতা দেখালেও, এখানেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল ব্যর্থতা।
মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক