রাজনীতি বনাম মাইনাস ফর্মুলা
মানুন আর নাই মানুন, গেল পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের দরুন দলটি আরও একঘরে হয়ে গেছে।
প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আসিফ আল মাহমুদ
সুস্থধারার রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। তার বদলে জায়গা করে নিয়েছে প্রতিহিংসা আর মাইনাসের কূটকৌশল! রাজনীতির এই বিয়োগ অধিকন্তু নিষিদ্ধকরণের ভয়ানক খেলায় এবার সদ্যপতিত আওয়ামী লীগ ঘরানার সংগঠন 'ছাত্রলীগ'-কে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার! যেখানে অন্তর্র্বর্তী সরকার বর্তমানে বহুমুখী চাপের ভেতর দিয়ে বস্তুত কঠিন এক সময় পার করছে, সেখানে কেন এখনই এমন একটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো তার অনেক কারণ থাকতে পারে। তন্মধ্যে, বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে একেবারেই স্বস্তিতে নেই! সার্বিক আইনশৃঙ্খলার নিদারুণ অবনতি তথা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী আকাশ ছোঁয়া দৌড়ে সরকার যারপরনাই অসহায়! এহেন অস্থিতিশীলতা কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো যদি 'ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে' নামে তবে সেক্ষেত্রে অপরিহার্য শক্তি হচ্ছে ছাত্রলীগ! সুতরাং, ছাত্রলীগকে বেআইনি ঘোষণা করা হলে তাদের মোকাবিলা ও দমন করার আইনি সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে বৈকি! কেননা একটি স্বীকৃত, বৈধ সংগঠনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেরূপ আচরণ করে, অবৈধ কিংবা বেআইনি সংগঠনের সঙ্গে সেরূপ আচরণ দেখায় না। তার ওপর এখনো পর্যন্ত অন্তর্র্বর্তী সরকার যে ঠিকঠাক সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারছে না তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো পুলিশ প্রশাসনের যথাযথ সক্রিয়তার অভাব। এ কথা অনস্বীকার্য যে বিগত পনেরো বছরে পুলিশ বাহিনীতে যত নিয়োগ হয়েছে তার বিরাট একটি অংশই হয়েছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের দলীয় পরিচয়ে! এই তরিকায় নিয়োগপ্রাপ্তরা বর্তমান সময়ে এসে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে যদি অসহযোগিতা করে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি এদের মধ্যে এমনও আছেন যারা ছাত্রজীবনে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন! তাই পুলিশ প্রশাসন এবং রাষ্ট্রের অন্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় থেকে এসব ব্যক্তিকে অপসারণ করাই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধকরণের আরেকটি নিমিত্ত হতে পারে।
তবে সম্প্রতি জনমনে ঘুরে-ফিরে সেই একটি প্রশ্নই বারবার উঁকি দিচ্ছে! বিয়োগের এই প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক খেলায় শেষমেশ আওয়ামী লীগকেও কি বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দান থেকে নিষিদ্ধ করা হবে? স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট, জামায়াতে ইসলামীকেও প্রতিহিংসার বিধ্বংসী খেলায় মত্ত হয়ে তদানীন্তন আওয়ামী সরকার ঠিক একইভাবে এ দেশের রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য 'মাইনাস ফর্মুলা' প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিল। এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে যেসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের একসময় মজবুত জনভিত্তি ছিল, যারা একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিল এবং যাদের বিরাট ভোটব্যাংক রয়েছে, নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ হলে বিপুলসংখ্যক মানুষ যাদের ভোট দেবে তেমনই কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা বা রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা আখেরে মোটেও সফল হয় না।
মানুন আর নাই মানুন, গেল পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের দরুন দলটি আরও একঘরে হয়ে গেছে।
অবিবেচকের ন্যায় হুটহাট বেশকিছু আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে তারা স্পষ্টতই কোণঠাসা হয়ে পড়ে! কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দলটিকে অকস্মাৎ দেশের রাজনীতি থেকে 'মাইনাস' করে দেওয়া দুরূহ! এমনিতেও আওয়ামী লীগের যে জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে, এতে ভোটের মাঠে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার খোদ জনগণের ওপরই ছেড়ে দেওয়া যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গতও বটে।
মোট কথা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা আর 'মাইনাস ফর্মুলা'র যথেচ্ছ প্রয়োগে দেশকে খুব একটা এগিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয় না। যার ইদানীন্তন ও যথোপযুক্ত উদাহরণ 'আওয়ামী লীগ' নিজেই! কেননা এই জিঘাংসা তদুপরি অহমিকার নোংরা খেলাই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের নীলনকশা রচনা করেছিল! 'মাইনাস থেরাপি'-কে ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকা ও একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের 'ট্রাম্প কার্ড' গণ্য করাই তাদের আজকের এই ভয়ংকর পরিণতির পেছনে সবচাইতে জোর ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে! তর্জনী উঁচিয়ে হাতের ইশারায় একচেটিয়া যাচ্ছেতাই জবরদখল বুমেরাং হয়ে তাদের দিকেই ফিরে এসেছে! ক্ষমতার গদি বাঁচানোর তাগিদে এভাবে খামখেয়ালি ব্যবহার, 'মাইনাস ফর্মুলা'-কেই প্রকারন্তরে স্বয়ং রাজনীতির জটিল প্রতিপক্ষ করে তুলছে! কে বলতে পারে, শেষমেশ হয়তোবা লড়াইটা 'সুস্থধারার রাজনীতি বনাম বিয়োগের সংস্কৃতি'-তে এসে ঠেকবে! যার অমোঘ পরিণতিতে গোটা দেশ আর দেশের মানুষকেই হয়তো কড়া মাশুল গুণতে হবে!
আসিফ আল মাহমুদ : নবীন কলাম লেখক