পুনর্গঠনের পথে বাংলাদেশ

পরিবর্তনের জন্য শুধু উপরিকাঠামোর পরিবর্তন নয়, ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। একত্রিত হতে হবে আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবেও। অভু্যত্থান-পরবর্তী সময়ে বিভক্তি সৃষ্টি না করে সবাইকে ঐক্যের বন্ধনে বাঁধতে হবে, দরকার সমন্বয়ের (রিকনসিলিয়েশন) মাধ্যমে বিভেদ ভুলে এক হয়ে যাওয়ার। এই পথে ছাত্রনেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যেমন থাকবে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যও হবে অপরিহার্য।

প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মুহাম্মাদ ত্বলহা আমিন
জুলাইয়ের বিপস্নব- বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ছাত্র-জনতার মিলিত সংগ্রামে যে অভু্যত্থান ঘটেছে, তা কেবল একটি বিদ্রোহ ছিল না, বরং এটি ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনতার অন্তর্গত ক্ষোভের এক বিস্ফোরণ। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের শপথ নিয়েছিল। এটা নিছক একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা ছিল না, বরং দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। এই বিপস্নব আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সাম্য, ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহির ভিত্তিতে নতুন এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। আজকের বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রয়াসে এই আন্দোলনের চেতনা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। এক. বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে যেন ক্রমশ জমে উঠেছিল চাপা ক্ষোভ আর অন্তর্গত হতাশা। ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া প্রভাব, স্বৈরাচারী আচরণ আর সাধারণ মানুষের অধিকারকে উপেক্ষা করার সংস্কৃতি- এসবের ফলেই জনগণ, বিশেষত যুবসমাজ এবং শিক্ষার্থীরা ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিল। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার হলেও জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সেভাবে দেখা যায়নি। জনগণের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা স্থায়ী করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল আর এ পথে তারা কোনো অন্যায় বা নিষ্ঠুরতায় পিছপা হয়নি। সেনা কর্মকর্তা হত্যা, শাপলার হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি, চব্বিশের গণহত্যার মতো ঘটনাগুলো সেই নিষ্ঠুরতারই সাক্ষী। অহংকার আর অবজ্ঞার এই রাজনীতিতে শাসকের নিষ্ঠুরতার ছাপ যেন এক সময় নিয়মে পরিণত হয়। ২৪ জুলাইয়ের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সেই সাহসী সন্তানদের হাত ধরে, যারা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার। ধনী পরিবারগুলোতে চাকরি না পেলেও জীবন চালিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু শহীদ আবু সাঈদের মতো পরিবারের সন্তানরা সেই সুযোগ পায় না। তারা দেখেছে, এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কোনো সত্যিকার সমতা নেই- যেখানে ধনীরা ঘুষের বিনিময়ে চাকরি কিনতে পারে, সেখানে তাদের মতো নিরীহদের জন্য অধিকার যেন অধরাই থেকে যায়। আর তাই আবু সাঈদ আর ওয়াসীমের মতো তরুণরা এই বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৃপ্ত শপথে নেমেছিল। প্রমাণ করে দিয়েছিল, বৈষম্যহীন সমাজই তাদের লক্ষ্য। প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করবে, তবু অপমান আর অন্যায় সহ্য করে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। তরুণ প্রজন্ম, যারা এই বিপস্নবের নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা বুঝতে পেরেছিল যে, শুধু নির্বাচনী বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারেই পরিবর্তন আসবে না, বরং গোড়া থেকেই শাসন ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে। সংস্কার আনতে হবে পুরোদমে। তাই দেখা যায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও আন্দোলনটি ধীরে ধীরে এক দফার লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছেছিল। দুই. এই অভু্যত্থানের প্রধান অর্জন হলো সাধারণ মানুষের মনের মুক্তি। স্বৈরশাসনের রুদ্ধ বেষ্টনী ভেঙে এক সফল গণ-আন্দোলন- যা জনমানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তির এক উজ্জ্বল প্রতিফলন। এই বিদ্রোহ মানুষকে নতুন করে বিশ্বাস করিয়েছে যে, তারা শুধু পরিস্থিতির শিকার নয়, বরং তারাই পরিবর্তনের স্থপতি। প্রতিটি মানুষ যদি তার দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে দেশের কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। এভাবেই ধীরে ধীরে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষ, এমনকি রিকশাওয়ালা মামাও সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন এই গণ-আন্দোলনে। এই বিপস্নবের অনুরণনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জেগে ওঠে স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার এক নবীন উদ্দীপনা। তারা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, কেবল নেতৃত্বের পরিবর্তন যথেষ্ট নয়; সুশাসনের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়, নৈতিকতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। তরুণ প্রজন্মের এই শক্তি কেবল স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েই সন্তুষ্ট থাকেনি, বরং তারা শুরু করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কল্পনা করতে- একটি এমন স্বদেশ, যেখানে মানুষে মানুষে সম্মান, ন্যায়বিচার এবং সাম্যের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়বে। জুলাইয়ের এই বিপস্নব নতুন দিনের আশাবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে। পরিবর্তনের সম্ভাবনাগুলোকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছে তরুণদের চোখে, যারা একদিন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপকার হবে। তিন. এই অভু্যত্থানের পর বাংলাদেশের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় জাতির পুনর্গঠন। সর্বাগ্রে, শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ফাঁপা বুলি আওড়ানো হলেও এর বাস্তবায়ন নানা ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ রয়েই গেছে। তাই সুশাসনের জন্য প্রয়োজন এমন একটি কার্যকর রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ এবং প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা থাকবে। এই লক্ষ্যে একটি ২১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয় আগস্টে, যেখানে নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয়ে এক সুশৃঙ্খল দল কাজ শুরু করে। তাদের এই সমন্বয় যেমন একদিকে অভিজ্ঞতার গভীরতা জোগায়, তেমনি অন্যদিকে, নতুন প্রজন্মের সাহসী চিন্তাধারাকে শক্তি দেয়। তারা দায়িত্ব পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যদিও কিছু প্রশ্ন ও জটিলতার সমাধান এখনো বাকি। তবুও জাতি তাদের প্রতি আস্থাশীল এবং প্রায় তিন মাস পেরিয়ে আসার পর জাতি তাদের কাছ থেকে আরও দৃশ্যমান ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপের প্রত্যাশা করছে। এই প্রেক্ষাপটে নাগরিকদেরও তাদের নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কারণ, একটি রাষ্ট্রের সঠিক পুনর্গঠনে শুধু সরকারের প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়। প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সুশাসন ও ন্যায়বিচারের জন্য নিজের অবস্থান থেকে অবদান রাখা। জুলাইয়ের এই বিপস্নব কেবল একটি পরিবর্তনের সূচনা নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে এক অবিনশ্বর প্রেরণা। চার. জুলাই গণ-অভু্যত্থানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশাল। অন্তত দেড় দশকের বিভাজনমূলক ভাষা ও চিহ্নব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে এই অভু্যত্থানের ভাষিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি গড়ে উঠেছে। এই সময়কালে পরস্পরবিরোধী মতাদর্শিক বিভাজন আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে মজবুত করেছে। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী শাসনামল বিভাজনের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিল। সেকু্যলার বনাম ইসলাম পন্থা, ধর্ম বনাম প্রগতি, শাহবাগ বনাম শাপলা ইত্যাদি মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক বিরোধগুলোর গোড়ায় আওয়ামী লীগ বরাবরই পানি দিয়েছে, কারণ তারা জানত যে বিভাজনই ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার প্রধান কৌশল। ২৪ জুলাইয়ের বিপস্নব শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। এটি ছিল সাধারণ জনগণের অপ্রতিরোধ্য অংশগ্রহণের ফল। হাসিনার পাতানো বিভাজনের রাজনীতি ছিন্ন করে সাধিত হয়েছে এই গণ-অভু্যত্থান। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের পুনর্গঠনের দায়িত্ব আমাদের সবার এবং সেই লক্ষ্যে নাগরিকদের ভূমিকা নির্ধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনকাল ছিল অগণতান্ত্রিক ও জনসম্মতিহীন। এ শাসনকাল স্রেফ শক্তি প্রদর্শনেই টিকে ছিল না, বরং গুম, খুন, ক্রসফায়ার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অবাধ লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং সিন্ডিকেট চর্চার মাধ্যমে শাসনকে চিহ্নিত করেছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, এই শাসনের পেছনে কাজ করেছে একটি সূক্ষ্ণ সাংস্কৃতিক রাজনীতি- যা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়ক ছিল। সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব বয়ান তৈরি করে তা পুরো জাতিকে গেলানো। অথচ পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের অগণতান্ত্রিক মনোভাব ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অনুঘটক। অর্থাৎ খোদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে যে বয়ান ছিল, তা-ই ছিল মুক্তিযুদ্ধপরিপন্থি। পাঁচ. বারবারই ছাত্র ও জনতার আন্দোলন এই ভূখন্ডে সাফল্যের মুখ দেখেছে। তবে দুঃখজনকভাবে সেই বিজয়ের প্রকৃত ফল কখনোই এই জনপদের সাধারণ মানুষ উপভোগ করতে পারেনি- হোক তা '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণ-অভু্যত্থান, বা '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম। এবারও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয়ের সুফল যেন আমাদের হাতছাড়া না হয়, সে লক্ষ্যে আমাদের সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে। এই বিপস্নবী সরকার যদি পরাস্ত হয়, তাহলে শুধু সরকারই নয়, গোটা বাংলাদেশ হেরে যাবে, হুমকির মুখে পড়বে এই আন্দোলনের অগ্রগামী শহীদ প্রাণগুলোর আত্মত্যাগ। তাই প্রতিটি সেক্টরে সঠিক, দৃঢ় এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ আজ সময়ের দাবি। মোটাদাগে আমাদের কিছু করণীয় : ১. শিক্ষা ও সচেতনতার বিকাশ : শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা আবশ্যক। এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে- যা কেবল পড়াশোনার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের ওপর জোর দেবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক ইতিহাস, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষাও প্রচার করা জরুরি। ২. ইনসাফ ও সুশাসনের প্রতিষ্ঠা : একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সমাজে সুবিচার ও সহনশীলতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি সামাজিক অবিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সব নাগরিককে সোচ্চার হতে হবে। আমাদের নিজেদের মধ্যে ইনসাফের চর্চা শুরু করতে হবে এবং এই মানদন্ডকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ৩. দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম : দুর্নীতির মূলোৎপাটনে প্রতিটি নাগরিকের সক্রিয় ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে, তা স্বৈরাচারী শক্তিকে দুর্বল করতে সহায়ক হবে। জনগণকে কর আদায়, রাষ্ট্রীয় খরচ এবং প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ৪. গণতন্ত্র ও জনাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো : বাংলার প্রান্তে প্রান্তে দানাবাঁধা মানুষের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রতিফলিত করা অপরিহার্য। প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের মতামত, প্রত্যাশা এবং চাহিদাকে শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণকে সংগঠিত হতে হবে। ৫. মানবাধিকার প্রসার: দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে নাগরিকদেরও এই অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। নারীর প্রতি বৈষম্য, শিশু শ্রম এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সব মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে জনগণকেই সোচ্চার হতে হবে। এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করলে তবেই এই বিজয় আমাদের প্রকৃত অর্জন বলে গণ্য হবে আর দেশের পুনর্গঠনে এই বিপস্নবী সাফল্যের আসল স্বাদ অনুভব করতে পারব আমরা, এ জনপদের সাধারণ মানুষ। ছয়. জুলাইয়ের এই বিপস্নব আমাদের জন্য রচনা করেছে এক আলোকিত পথচিত্র, দিয়েছে এক নবযুগের সুরভিত দিশা। জাতির ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনে এই বিপস্নবের মর্মবাণী ধারণ করেই প্রয়োজন এক নতুন সংবিধানের- যা আমাদের সংগ্রামের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করবে এবং বুনে দেবে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের ভিত। এই পথে আমাদের লক্ষ্য হতে হবে এমন এক সমাজ গঠন- যা হবে জবাবদিহিমূলক, যেখানে গণতন্ত্র, নৈতিকতা এবং মানবাধিকারের দীপ্তি প্রতিটি স্তরে সজীব থাকবে। রাষ্ট্রনায়কদের ওপর যেমন এ দায়িত্ব বর্তায়, তেমনি প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ জায়গা থেকেও দায়িত্ব নিতে হবে। এই আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তরুণ সমাজের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। সমাজের ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত- সব শ্রেণি থেকে ওঠে আসা তরুণরা, কেউ সেকু্যলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, আবার কেউ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী- সবাই একই কাতারে দাঁড়িয়ে এই জনযুদ্ধে লড়েছে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এই ভোগবাদী সমাজে ছাত্র-জনতার এমন গণ-অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে বৈপস্নবিক- যা আমাদের জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে। জুলাই আমাদের শিখিয়েছে, পরিবর্তন অসম্ভব নয়, বরং পরিবর্তন সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দেয়। শুধু প্রয়োজন আমাদের ঐক্য, দৃঢ়তা এবং অঙ্গীকার। দেশের পুনর্গঠনের এই মহাসড়কে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা নিশ্চিত করতে হলে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে- একটি দেশ, যা গড়ে উঠবে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের সঙ্গে। পরিবর্তনের জন্য শুধু উপরিকাঠামোর পরিবর্তন নয়, ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। একত্রিত হতে হবে আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবেও। অভু্যত্থান-পরবর্তী সময়ে বিভক্তি সৃষ্টি না করে সবাইকে ঐক্যের বন্ধনে বাঁধতে হবে, দরকার সমন্বয়ের (রিকনসিলিয়েশন) মাধ্যমে বিভেদ ভুলে এক হয়ে যাওয়ার। এই পথে ছাত্রনেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যেমন থাকবে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যও হবে অপরিহার্য। তাদের অবিচল প্রতিজ্ঞাই নিশ্চিত করবে যেন কোনো নতুন স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এবং কোনো বহিরাগত শক্তি আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার সাহস না পায়। এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়ই আমরা আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তা, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে পারব এবং সব অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে গড়ে তুলতে পারব একটি আলোকিত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। মুহাম্মাদ ত্বলহা আমিন : কলাম লেখক