শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কমিটি গঠন নাকি প্রহসন?

তিনবারের বেশি তো আর অংশগ্রহণ করা যাবে না। তাই প্রস্তুতিটা হওয়া চাই মজবুত, এতে একাডেমিক পড়ার যা হয় হোক। কেবল কোনোমতে সেকেন্ড ক্লাস থাকলেই হলো। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ রকম মানসিকতাই জেঁকে বসবে। তাই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া বয়সসীমা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
মাহতাব মুহাম্মদ
  ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কমিটি গঠন নাকি প্রহসন?

অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণ করার বিধান নির্ধারিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রি.) তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। চাকরিতে প্রবেশের এই বয়সসীমা নির্ধারণের পেছনে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আদতে আন্দোলনের যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে, না কি কয়েকজন আমলা আর নির্দিষ্ট কিছু সমন্বয়কের কথার প্রতিফলন ঘটেছে? গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলনের দাবির সঙ্গে বয়সসীমা ৩২ নির্ধারণের সিদ্ধান্তে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এই সিদ্ধান্তে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির ডের অমিল। আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারণ। কিন্তু ৩৫-এর বদলে ৩২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে আন্দোলনরত চাকরিপ্রত্যাশীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এর আগেও বিভিন্ন সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করেছে। অথচ পুলিশের এই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সংগ্রাম করেই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এখন তারাই সেই স্বৈরাচারীর মতো লাঠিপেটা করার ভূমিকায় হাজির। পরে অবশ্য আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদল অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবন যমুনায় গিয়ে দেখা করেন। প্রধান উপদেষ্টা তাদের আশ্বাস দেন বয়সসীমা ৩৫ করার। এর আগে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে দেখা করলে তিনিও বয়সসীমা ৩৫-এর পক্ষে মত দেন ও আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরতে বলেন। পরে সরকারি চাকরির বয়সসীমা কত হতে পারে, সেটা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে সদস্যসচিব করে একটি কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আরও ছিলেন সাবেক যুগ্মসচিব কওছার জহুরা, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল ও তখনকার অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বর্তমানে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে বয়সসীমার বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কমিটিও আন্তরিকতার সঙ্গে সব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে ৯ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনটিতে পর্যালোচনা কমিটি সব কিছু বিবেচনা করে ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ৩৭ বছরের সুপারিশ করে। কিন্তু বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রি.) হঠাৎ জানা গেল, বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে কমিটি গঠনের দরকার কী ছিল? যদি সরকারের আগে থেকেই ৩২ বছর নির্ধারণ করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে লোক দেখানো পর্যালোচনা কমিটি গঠনের মানে কী? যে পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শই মানা হবে না, সেই কমিটি গঠন করে লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে ঠাট্টা করার কী দরকার ছিল? এটা তো প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। এ জন্যই এটিএন নিউজের এক টকশোতে সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল দুঃখ করে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে আইন হয় একজন লোকের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর। ট্র্যাজেডি হলো- এখানে।' তিনি ৩৫ বিরোধী এক আমলা ও উপদেষ্টার নাম নিয়ে বলেছিলেন, 'এবং এটা এই গভর্মেন্ট করবে না, আমি জানি। কী কারণে করবে না? ওই যে আছে, একজন আমাদের, আমলার শিরোমণি একজন আছে উপদেষ্টার দায়িত্বে। ওনি এটা করতে দেবেন না। ওনি এটার ঘোরবিরোধী।' অবশেষে সাংবাদিক মাসুদ কামালের কথাই সত্য হলো। বয়সসীমা ৩৫ হলো না, হতে দেওয়া হলো না। এ দেশে নিপীড়িত জনগণের কথার যে কোনো দাম নেই, সেটাই প্রমাণিত হলো। সরকার পরিবর্তন হলেও সিস্টেম ও মানসিকতার পরিবর্তন নেই। 'যেই যায় চেয়ারে, সেই থাকে ড্যাম কেয়ারে।' কে কী বলল, জনগণ কী ভাবল, সেটা ভাবার টাইমই তাদের নেই। আন্দোলন চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক সারজিস আলম বয়সসীমা ৩২ নির্ধারণের পক্ষে জোরাল মত দিয়েছিলেন। দেখা গেল, সেই ৩২-ই হয়েছে। ৩২ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিনি আবার ফেসবুকে এই সিদ্ধান্তকে মহাযৌক্তিক বলে উলস্নাস করেছেন। সরকারের গঠন করে দেওয়া পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশকে উপেক্ষা করে কিছু সমন্বয়ক ও কতিপয় আমলার দাবির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত এলো। তাহলে সিদ্ধান্তটা আসে কই থেকে? সরকারের কাছের কিছু নির্দিষ্ট লোক থেকে না কি যৌক্তিকতা থেকে, জনগণের দাবি থেকে? যদি আসলেই সমন্বয়কদের বিরোধিতা ও কতিপয় আমলার গোয়ার্তুমির কারণে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে কতিপয় সমন্বয়ককে খুশি করার জন্য সিদ্ধান্ত এসে থাকে, তবে এটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। এটি যেন আবার ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদের বীজ বপন না হয়। ফ্যাসিবাদ এ রকম ছোট ছোট বীজ বপন থেকেই শুরু হয় আর শেষ হয় গণহত্যা দিয়ে। হাসিনাও কারও কথা শুনত না, জনগণের চাওয়া-পাওয়ার দিকে ভ্রম্নক্ষেপ করত না। পরিণামে ধীরে ধীরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন সে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গণহত্যা চালাতেও দ্বিধা করেনি। বর্তমান সরকার যদি একইভাবে জনগণের দাবির দিকে না তাকিয়ে কতিপয় ব্যক্তিবিশেষের টোটকায় দেশ চালায়, তাহলে তাদেরও জনবিচ্ছিন্ন হতে তেমন সময় লাগবে না। এ দেশে ৬০-৭০ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা হতে পারলেও ৩২-এর পর অন্য কেউ সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারবে না। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ৩৫-এর পর না কি কর্মক্ষমতা কমে যায়। তাই যদি হয়, তাহলে ৬০-৭০ বছরের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টাদের কর্মক্ষমতার হালত কী? ৩৫ বছরের পর কর্মক্ষমতা কমে গেলে এত বয়সি প্রধান উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, আমলাদের তো কর্মক্ষমতা থাকারই কথা নয়। তবুও কেন তারা বিভিন্ন সময় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, সপদে বহাল থাকে? চাকরিতে বয়সসীমা বৃদ্ধির বিপক্ষে আরেকটি খোঁড়া যুক্তি দেওয়া হয় যে, বয়সসীমা বাড়ালে না কি বেকারত্ব বাড়বে। তো বয়সসীমা না বাড়ালে কি বেকারত্ব চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যাবে? বয়সসীমা ৩৫ কখনো উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা নয়। বয়সসীমা ৩৫ করলে সবাই কোনো পেশায় না জড়িয়ে ৩৫ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, তেমনটা ভাবার কারণ নেই। বেশিরভাগই অন্য কাজের পাশাপাশি সরকারি চাকরির চেষ্টা চালাবে। তারা তো চাকরি চাচ্ছে না। তারা শুধু সরকারি চাকরির বাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ চাচ্ছে, যে সুযোগ বিশ্বের ১৬২টি দেশ বয়সসীমা ৩৫ বা তদূর্ধ্ব নির্ধারণ করে তাদের নাগরিকদের দিয়েছে। এতে সমস্যা থাকার কথা নয়। এদিকে বিসিএস পরীক্ষায় তিনবারের বেশি অবতীর্ণ হওয়া যাবে না শীর্ষক সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়ার ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলবে। আগে যেমন ছেলেমেয়েরা অনার্স থার্ড ইয়ার, ফোর্থ ইয়ারে গিয়ে একাডেমিক পড়ায় গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত, এখন অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে। পারলে তো এইচএসসি থেকেই শুরু করে আর কী! কারণ,

তিনবারের বেশি তো আর অংশগ্রহণ করা যাবে না। তাই প্রস্তুতিটা হওয়া চাই মজবুত, এতে একাডেমিক পড়ার যা হয় হোক। কেবল কোনোমতে সেকেন্ড ক্লাস থাকলেই হলো। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ রকম মানসিকতাই জেঁকে বসবে। তাই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া বয়সসীমা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

মাহতাব মুহাম্মদ :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে