ইউনিয়ন পরিষদের সংকট কাটিয়ে দ্রম্নত গতিশীলতা আনতে হবে
ইউপি চেয়ারম্যানদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং তাদের মধ্যে যারা দায়িত্ব পালনে অক্ষম, তাদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করার মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সচল রাখা সম্ভব। এটি করলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পুনরায় স্থিতিশীল হবে এবং জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে না।
প্রকাশ | ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দেশের শাসন কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের জন্য সেবা নিশ্চিত করে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে সরকার। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব হলো স্থানীয় সেবা, যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং মাতৃত্বকালীন ভাতা বিতরণ। এছাড়া, জন্ম ও মৃতু্য নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সম্প্রতি সারাদেশে ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতি ও তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই কার্যক্রমগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে তৃণমূলের জনগণ বিভিন্ন সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পতন ও পলায়নে, ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে সারাদেশে অনেক ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ১,৪১৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান বর্তমানে কর্মস্থলে অনুপস্থিত- যা মোট ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এসব চেয়ারম্যানের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই গুরুতর অভিযোগ, বিশেষত হত্যা মামলা রয়েছে। ফলে, তারা নিজেদের কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের সেবাপ্রাপ্তির অধিকার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম কার্যত থমকে গেছে এবং ভাতা বিতরণ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রমগুলোও স্থবির হয়ে পড়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা বিতরণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। পাশাপাশি, যারা ওয়ারিশ সনদ, চারিত্রিক সনদ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে ইউনিয়ন পরিষদে আসছেন, তারা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কোনো সেবা পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদে খন্ডকালীন সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা যথাযথভাবে কাজ করছেন না। এ কারণে স্থানীয় জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছে।
ইউপি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। প্রতিবেদন অনুসারে, বেশিরভাগ মামলাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে দায়ের করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব মামলার পেছনে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের অভাব রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপকে অনেকে স্থানীয় সরকারের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন- যা দেশজুড়ে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও দুর্বল করে তুলছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শহরাঞ্চলে বেশ কিছু পরিবর্তন হলেও গ্রামাঞ্চলে ইউপি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এই ধরনের পদক্ষেপ শুধু তাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করছে না, বরং জনগণের সেবা পাওয়ার অধিকারও হরণ করছে।
সরকার ইতোমধ্যেই সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান হতে পারে না। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ এই পরিস্থিতির সমাধানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পরিবর্তে ইউপি চেয়ারম্যানদের একটি নোটিশ জারির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, সরকার প্রথমে চেয়ারম্যানদের পরিষদে উপস্থিত হতে নোটিশ দিতে পারে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা উপস্থিত না হলে আসন শূন্য ঘোষণা করে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে, পরিষদের কাজগুলো অব্যাহত থাকবে এবং প্রশাসনিক শূন্যতা তৈরি হবে না। বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনও মনে করে যে, ইউপি ভেঙে দিলে বা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে প্রান্তিক পর্যায়ের সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তারা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদগুলো প্রান্তিক জনগণের জন্য প্রধান সেবা প্রদানকারী সংস্থা এবং সেগুলোর কার্যক্রমে কোনো বিঘ্ন ঘটলে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক দলের প্রভাব নতুন কিছু নয়। বিগত সরকারগুলোও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করেছে এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থে বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগ করেছে। বিশেষ করে, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় সরকারকে তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিরোধী মতের জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করার জন্য নানা ধরনের অসৎ কৌশল নেওয়া হয়েছিল- যা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়। স্থানীয় সরকারকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কারণ তৃণমূলের জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে হলে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা এবং স্থানীয় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল ও কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সরকারের উচিত এই সংকট নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা- যা স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করবে এবং তৃণমূলের জনগণের সেবা নিশ্চিত করবে। প্রথমত, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো পুনর্বিবেচনা করে ন্যায্য তদন্তের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর কার্যক্রম পুনরুদ্ধার এবং তৃণমূলের জনগণের আস্থা ফেরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর শক্তিশালী ভূমিকা নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা। ইউপি চেয়ারম্যানদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং তাদের মধ্যে যারা দায়িত্ব পালনে অক্ষম, তাদের নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করার মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সচল রাখা সম্ভব। এটি করলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পুনরায় স্থিতিশীল হবে এবং জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে না।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল :চিকিৎসক ও লেখক