বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগপ্রবণ দেশ। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে চরম আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগের ঘটনা ঘটছে। বন্যা, শৈত্যপ্রবাহ, ঝড়, বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় লেগেই আছে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বলা দরকার, সম্প্রতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় 'দানা' বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কের বিষয় সামনে এসেছে। এছাড়া, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে হওয়া দমকা বাতাসে গাছের ডাল ভেঙে উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনায় একজনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে বার্জের ধাক্কায় কক্সবাজারের ইনানি সৈকতে ভেঙে গেছে নৌবাহিনীর জেটি। তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের ভুবনেশ্বরে স্থল ভাগে আঘাত হানতে শুরু করে। দেশটির আবহাওয়া বিভাগ জানায়, এ সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার- যা ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
প্রসঙ্গত, আমরা বলতে চাই, শুধু সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় নয়, এর আগেও ভয়াবহ ঘূণিঝড়, বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গত কারণেই এটা মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ, দুর্যোগকে এড়ানোর কোনো উপায় নেই। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, যথাযথ প্রস্তুতি ও উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। ফলে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নিশ্চিত করা জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়। বলা দরকার, এমনটিও জানা গেছে- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে 'দানা' নামের ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে নতুন শঙ্কা যেমন জাগিয়েছে- তেমনি এটাও খেয়াল করা জরুরি- ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত, খরা ও অসময় বৃষ্টি যেন পিছু ছাড়ছে না। বছরের পর বছর দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে টিকে আছে, কোন কৌশলে তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে, তা জানতে ও দেখতে বিশ্বের বড় বড় গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে আসছেন। এছাড়া, দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবিলা এবং জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বিশ্ব উদাহরণ। দুর্যোগ ও যুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই বাংলাদেশের মানুষের মনের জোর ও লড়াই করার শক্তি বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে- যা আশাব্যঞ্জক। তদুপরি আমরা মনে করি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও বেশি সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
একইসঙ্গে লক্ষণীয়, বড় বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ হলেও নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে আছে। যানজট, জলাবদ্ধতা, সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প আর অগ্নিকান্ডে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। বিশ্বে অগ্নি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা শহরকে। ভূমিকম্পসহ নগরকেন্দ্রিক বহু ঝুঁকির ক্ষেত্রে কোনো প্রস্তুতি নেই এমনটিও জানা গেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড না মানা, ভূমিকম্পপরবর্তী জরুরি উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের অনভিজ্ঞতায় ঢাকা হয়ে ওঠছে মরণ ফাঁদ। দুর্বল ও ভঙ্গুর পদ্ধতির গ্যাস, বিদু্যৎ ও পানির লাইন নগর দুর্যোগ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিশাল কার্যক্রম একই ছাতার নিচে আনতে না পারলে দুর্যোগপরবর্তীকালে সুষ্ঠুভাবে উদ্ধারকাজও চালানো সম্ভব হবে না। তাই এবার নজর দিতে হবে নগরে। ফলে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যেমন যথাযথ প্রস্তুত থাকতে হবে, তেমনিভাবে নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে থাকার বিষয়টিও এড়ানো যাবে না।
সর্বোপরি আমরা উলেস্নখ করতে চাই, সাম্প্রতিক সময়ে এই আলোচনা বারবার সামনে এসেছে যে, লা নিনা সক্রিয় হওয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অন্যদিকে, ২০১৭-১৮ সাল ছিল লা নিনা বছর। অধিকাংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সময়ে হয়েছে এবং অনেকটা লা নিনার কারণে হয়েছে। ২০১৭ সালে হাওড়ে আগাম বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে, সার্বিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে, নগর দুর্যোগের বিষয়টিও আমলে নিতে হবে। সামগ্রিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে করণীয় নির্ধারণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না।