মানহীন বেসরকারি ক্লিনিক

প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মো. মুজাহিদুল ইসলাম
স্বাস্থ্যসেবা একটি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পুঁজি করে স্বাস্থ্য খাতকে পরিণত করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ে অজ্ঞতাকে পুঁজি করে দেশব্যাপী প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বিভিন্ন মানহীন ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যার ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, ঘটছে অকাল মৃতু্যর মতো ঘটনা। শহরের তুলনায় গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা দানের নামে সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠছে মানহীন ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে শহরের তুলনায় গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে জ্ঞানের স্বল্পতা থাকায় ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা। গড়ে ওঠা এসব বেশিরভাগ ক্লিনিকে সেবা দানে নেই দক্ষ ডাক্তার, নার্স ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। ফলে মানহীন এসব ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে মিলছে না মানসম্মত চিকিৎসাসেবা বাড়ছে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ। মানহীন এসব ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন গর্ভবতী মহিলারা। এসব ক্লিনিকে অদক্ষ ডাক্তার ও নার্সসেবা দানের ফলে প্রায় সময় অকাল মৃতু্যর শিকার হতে হচ্ছে গর্ভবতী মায়েদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েরা অকাল মৃতু্যর হাত থেকে বেঁচে ফিরলেও অকাল মৃতু্যর শিকার হতে হচ্ছে নবজাতক শিশুদের। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত অনুন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রদানের কারণে বিভিন্ন টেস্ট পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্টের মতো মারাত্মক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সঠিক রিপোর্ট না পাওয়ায় দেওয়া হচ্ছে ভুল চিকিৎসা, যা পরে মারাত্মক কোনো জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে, সেখানে দক্ষ ডাক্তার ও নার্স না থাকার পরও অপারেশনের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। যা অনেক সময় মৃতু্যর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অকাল মৃতু্যর ফলে অনেক পরিবার তার পরিবারের উপার্জিত ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। দেশের মিডিয়া অঙ্গনে এসব অকাল মৃতু্যর সংবাদ প্রায় সময় পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ মৃতু্যর সংবাদ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে অপ্রকাশিত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া এসব বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী ভর্তির ব্যাপারে চালু রয়েছে বিভিন্ন কমিশন ব্যবস্থা। বিভিন্ন ক্লিনিক অনুযায়ী কমিশন হার ভিন্ন রকমের। বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে রোগী আনার জন্য বিভিন্ন দালাল শ্রেণি লোক কাজ করে থাকে। একজন রোগীকে ভর্তি করালে সেই রোগীর বিভিন্ন টেস্ট পরীক্ষা বাবদ যে টাকা হাসপাতালে ব্যয় হয়, এর একটি অংশ কমিশন বাবদ দেওয়া হয় দালাল শ্রেণির লোকদের। ফলে টাকার লোভে স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে নিশ্চিত না হলেও দালাল শ্রেণির লোক বিভিন্ন প্রলোভনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে নিম্নমানের ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা নিতে নিয়ে আসে। যার ফলে দিন দিন রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, মধ্যস্থলে লাভবান হচ্ছে মানহীন বিভিন্ন ক্লিনিক ও দালাল শ্রেণির মানুষগুলো। গড়ে ওঠা বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দেশের সুনামধন্য বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসকদের নাম। পাশাপাশি চিকিৎসা প্রদানে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। ফলে সাধারণ দরিদ্র মানুষদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসাসেবা নেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে এসব মানহীন বেসরকারি ক্লিনিককে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে নানা অবৈধ ওষুধ কারখানা। যাদের প্রধান লক্ষ্য এসব মানহীন বেসরকারি ক্লিনিকের মাধ্যমে রোগীদের কাছে ও বাজারে তাদের ভেজাল ওষুধ বিক্রি করা। ইতোমধ্যে ওষুধের বাজারগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ভেজাল ওষুধ, যা রোগ প্রতিরোধ না করে উল্টো মানুষকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত করছে। সাধারণত চিকিৎসাসেবায় সরকারিভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন নীতিমালা থাকলেও এসব ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে তা সম্পূর্ণভাবে মানা হচ্ছে না। গড়ে ওঠা বেশির ভাগ মানহীন বেসরকারি ক্লিনিকের অনুমোদনে রয়েছে টাকা দিয়ে অবৈধভাবে লাইসেন্স নবায়ন বিতর্ক। এ ছাড়া দেশব্যাপী এমন অনেক বেসরকারি অনুমোদনহীন ক্লিনিক রয়েছে, যারা এখনো আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের নিম্নমানের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় অভিযোগের ভিত্তিতে দেশব্যাপী অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও থেমে নেই অবৈধ ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠা। আইনের চোখে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বিভিন্ন অবৈধ পথ অবলম্বনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বিভিন্ন অবৈধ মানহীন বেসরকারি ক্লিনিক। মানহীন সব বেসরকারি ক্লিনিক বন্ধে এবং সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রয়োজন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা এবং দোষীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা। মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করা দোষীদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে তারা আইনের কোনো ফাঁকফোকর ব্যবহার করতে না পারে। নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে সবার চাওয়া, দেশের স্বাস্থ্য খাত হোক উন্নত, নিশ্চিত হোক সঠিক স্বাস্থ্যসেবা। মানহীন নিম্নমানের ভুল চিকিৎসায় যেন অকালে মরতে না হয় কোনো মানুষকে। কোনো শিশুকে যেন জন্মের পর তার মাকে হারিয়ে এতিমের মতো বড় হতে না হয়। সাধারণ মানুষের চাওয়া পূরণে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উচিত, দেশের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবা নিরসনে বিশেষ নজর দেওয়া। চিকিৎসা সেবা প্রদানে অক্ষম বেসরকারি ক্লিনিক সংস্কার করা, প্রয়োজনে বাতিলের মাধ্যমে মানুষের সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। মো. মুজাহিদুল ইসলাম সম্মান প্রথম বর্ষ, ইতিহাস বিভাগ রাজশাহী কলেজ ও সহযোগী সদস্য, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।