বর্তমান ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমান যুগে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন একটি সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানের এই ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়া একটি শক্তিশালী পস্ন্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে, যেখানে মানুষ তাদের চিন্তাধারা, সৃজনশীলতা এবং অভিজ্ঞতাকে সহজে শেয়ার করতে পারে। এমনকি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এবং অন্যান্য পস্ন্যাটফর্মে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ নতুন কন্টেন্ট তৈরি করছেন। যার ফলে, ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা হয়ে উঠেছে।
তরুণ প্রজন্মের কাছে এটি শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তার একটি পস্ন্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করছে। ফলে, ভাইরাল হওয়ার জন্য তরুণদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, যা অনেক সময় বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত এমন অনেক কন্টেন্ট চোখে পড়ছে, যা মুহূর্তেই লাখ লাখ মানুষ দেখছে, শেয়ার করছে এবং আলোচনাও করছে। বর্তমান সময় সামাজিক মাধ্যম আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন এত মানুষ এই ভাইরাল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে? কেন সবাই ভাইরাল হতে চাই? ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কেন এত প্রবল?
অনেকেই মনে করে, ভাইরাল মানেই সাফল্য। এই ধারণা তরুণদের মধ্যে একটি অপরিসীম চাপ সৃষ্টি করছে। তারা অদ্ভুত বা সাহসী কাজ করে লাইকের সংখ্যা বাড়াতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু তরুণ কষ্টকর বা বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। যা তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এসব কর্মকান্ড সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হলেও, এর পরিণতি অনেক সময় মারাত্মকও হতে পারে।
ভাইরাল হওয়া মানে একটি কন্টেন্ট দ্রম্নত সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়া, যা সামাজিক স্বীকৃতি ও খ্যাতি অর্জনের পথ তৈরি করে। যা অনেকের কাছে একটি আকর্ষণীয় লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত। কেননা, এটি শুধু পরিচিতি আনতে সাহায্য করে না, বরং বিভিন্ন ব্যবসায়িক সুযোগও সৃষ্টি করে। একটি ভাইরাল ভিডিও বা পোস্ট একজন ব্যক্তিকে অল্প সময়ের মধ্যে তার স্বপ্নের দুয়ারেও নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, ভাইরাল হওয়া কি সত্যিই সহজ?
না, ভাইরাল হওয়া সহজ নয়। এর জন্য সৃজনশীলতা, সময় এবং কিছুটা সৌভাগ্যেরও প্রয়োজন হয়। ভাইরাল হওয়ার জন্য এমন কন্টেন্ট তৈরি করতে হয়, যা মানুষের মনে দাগ কাটে, হাসায় বা ভাবায়। কিন্তু ভাইরাল হওয়ার এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এই ভাইরাল হওয়ার চেষ্টায় অনেকেই নিজেদের আসল পরিচয় ভুলে যায়। তারা নিজেদের প্রকৃত মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারে কেবলমাত্র জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য। এমনকি ভাইরাল হওয়ার জন্য অনেক সময় মানুষ অশ্লীল বা বিতর্কিত কন্টেন্টও তৈরি করতে বাধ্য হয়। এ ধরনের কন্টেন্ট সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে একজন ব্যক্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক ফলাফলও বয়ে আনতে পারে। এ ছাড়াও ভাইরাল কন্টেন্টের কারণে অনেক সময় অনেক লোকেরা অশ্লীল মন্তব্য ও ট্রোলিংয়েরও শিকার হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা এবং কটাক্ষের কারণে অনেকের আত্মবিশ্বাসও ভেঙে যায় এবং তারা মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হন। যা ব্যক্তি হিসেবে তাদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই ভাইরাল হওয়ার প্রবণতার কারণে ব্যক্তি সম্পর্কেও বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যা একে অপরের সঙ্গে তুলনা করার প্রবণতা বাড়ায়, এমনকি বন্ধুত্ব এবং সম্পর্কের মধ্যে অশান্তিরও সৃষ্টি করতে পারে। এই ভাইরাল হওয়ার চেষ্টায় অনেক মানুষ সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলেন। তারা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য প্রচলিত ধারায় চলে যান, যা সত্যিকার সৃজনশীল কাজের অভাব সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ, নতুন ও মৌলিক চিন্তাভাবনার বিকাশেও বাধাগ্রস্ত হয়। আবার ভাইরাল হওয়ার জন্য অনেক সময় গুজব এবং অপপ্রচারকে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইসু্যগুলোকে কেন্দ্র করে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়। ভুল তথ্যের মাধ্যমে দ্বন্দ্ব এবং বিভাজনেরও সৃষ্টি হতে পারে। এই একটি ভুল তথ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক অশান্তি এবং অসহিষ্ণুতা বাড়ায়। আবার বহু তরুণ ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে অস্থায়ী খ্যাতি অর্জন করলেও তারা তা স্থায়ী সাফল্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু পরে যখন তাদের সেই খ্যাতি হারিয়ে যায় তখন তারা হতাশ হয়ে পরে, যা তাদের জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করে।
ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা একটি উত্তেজনাপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া হলেও এর পেছনে লুকিয়ে আছে বহু নেতিবাচক দিক, যা মানসিক চাপ ও সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি করে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে তারা নিরাপদে এবং সুস্থভাবে নিজেদের প্রতিভা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ পায়। তাই ভাইরাল হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সত্যিকার অর্থে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া।
সৈয়দা ফারিভা আখতার
অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী।