আগামীর সম্ভাবনাময় মহাকাশ প্রযুক্তি

প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মো. জাহিদুল ইসলাম
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ এখন আগের চেয়ে আরও ভালোভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে পারছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির জালে ধরা দিচ্ছে মহাবিশ্বের সুপ্রাচীন অতীত। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বর্তমানে জানা যাচ্ছে আরও অনেক নতুন নতুন তথ্য। একদিকে যেমন রহস্যের সমাধান মিলেছে তেমনি অন্যদিকে ঘনীভূত হচ্ছে নতুন রহস্য। মহাকাশ অর্থনীতি বদলে দিয়েছে জীবনযাত্রার গতিকে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মহাকাশ প্রযুক্তি খাতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ হচ্ছে। উদ্ভাবন ও অর্থনীতির নতুন একটি বৃহৎ উৎস হওয়ায় এ খাতে উদ্যোক্তাদের ব্যাপক আগ্রহ। বিশেষ করে উচ্চ প্রযুক্তির উদ্ভাবনে মহাকাশ গবেষণা এখন উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। মহাকাশ অর্থনীতি এরই মধ্যে উন্নত বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেছে। ক্রমান্বয়ে তা পুরো বিশ্বের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। মহাকাশ পর্যটন থেকে শুরু করে মহাকাশ ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এছাড়াও মহাকাশ গবেষণায় বিপুল অংকের বিনিয়োগ করছে গুগল, অ্যামাজন, স্পেসএক্সসহ বড় বড় কোম্পানি, যা বিশ্বের উদ্ভাবন ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে। মহাকাশ প্রযুক্তি বলতে মূলত পৃথিবীর সীমানার বাইরে মহাকাশে বিভিন্ন কাজে (যেমন- মহাকাশযানের পরিচালনা, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি) ব্যবহৃত প্রযুক্তিকে বোঝায়। মহাকাশ প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে মহাকাশযান, উপগ্রহ, মহাকাশ স্টেশন এবং অরবিটাল উৎক্ষেপণের যানবাহন, গভীর স্থান যোগাযোগ, ইন-স্পেস প্রোপালশন এবং সমর্থন পরিকাঠামো সরঞ্জাম পদ্ধতিসহ অন্যান্য প্রযুক্তির বিস্তৃত বৈচিত্র্য। পৃথিবীর বাইরে আকাশের কোনো শুরু ও শেষ নেই। আদি-অন্তহীন এ আকাশকে মহাকাশ বলে। মহাকাশে অসংখ্য জ্যোতিষ্ক রয়েছে। এরা সুশৃঙ্খলভাবে নিজস্ব কক্ষপথে নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কোনো কোনোটার আলো আছে আবার কোনো কোনোটার আলো নেই। মহাকাশে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু, উল্কা, নীহারিকা, পালসার, কৃষ্ণবামন, কৃষ্ণগহ্বর প্রভৃতি সবকিছুই রয়েছে। এদের সবাইকে নিয়ে গঠিত হয়েছে এই মহাবিশ্ব। সম্প্রতি মহাকাশ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও অর্থনীতির নতুন একটি বৃহৎ উৎস হওয়ায় এ খাতে উদ্যোক্তাদের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ প্রযুক্তির উদ্ভাবনে মহাকাশ গবেষণা এখন উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বর্তমান আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে মহাকাশ প্রযুক্তি একটি অফুরন্ত সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আগামী দশকের মধ্যেই মহাকাশবিজ্ঞান হয়ে উঠবে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল নিয়ামক। বর্তমানের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে মহাকাশ প্রযুক্তি এখন হয়ে উঠেছে অর্থনীতির একটি বড় সম্ভাবনার খাত। এদিকে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির ক্রম উন্নয়ন এই প্রয়োজনীয়তাকে আরও বেশি অপরিহার্য করে তুলছে। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেটের উন্নয়ন, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ব্যয় কমে যাওয়া, প্রযুক্তির অভাবিত অগ্রগতি প্রভৃতির কারণে প্রতিনিয়তই ব্যাপক হারে মহাকাশশিল্পের দ্রম্নত সম্প্রসারণ হচ্ছে। সম্প্রচার, যোগাযোগ, আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি মহাকাশ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি সুরক্ষা ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানেরও বড় মাধ্যম। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক গবেষণার উন্নতি, রাষ্ট্রীয় গৌরব ও সম্মান অর্জন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব, মানুষের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিশ্চিত করা এবং সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতার উন্নয়ন ইত্যাদি মহাকাশ প্রযুক্তি প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বজুড়ে এখন মহাকাশবিজ্ঞান পরিণত হয়েছে মহাকাশ বাণিজ্যে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উভয়ই একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান মানেই চিন্তার ইতিবাচক পরিবর্তন। মানব জাতির কল্যাণে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন সেই ইতিবাচক চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় যুগের পর যুগ। আগামীর পৃথিবীর ভবিষ্যৎ এবং এর প্রবৃদ্ধি হবে মহাকাশ প্রযুক্তিনির্ভর। উপগ্রহ প্রযুক্তি ও মহাকাশ অনুসন্ধান হবে আগামী বছরগুলোতে টেকসই বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি হবে মহাকাশ প্রযুক্তি নির্ভর। মানবজাতিসহ মহাজাগতিক সবকিছু টিকে থাকলে শতবর্ষব্যাপী এর বিবর্তন, পরিবর্তন এবং চরমমাত্রায় আধুনিকায়ন চলতেই থাকবে। মহাবিশ্ব যে কত বড় তা কেউ জানে না। কেউ জানে না মহাবিশ্বের আকার বা আকৃতি কেমন। মহাবিশ্বের শুরু ও শেষ নেই। মানুষ প্রতিনিয়তই মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করে চলেছে। যার অনেক কিছুই এখনো অজানা রয়ে গেছে। এই অজানা হয়তো চিরকালই অজানাই হয়ে থাকবে। অথবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে অজানা এসব রহস্যের উন্মোচন ঘটবে। গবেষণার পাশাপাশি সামরিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে বড় দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার এই প্রযুক্তি এখন হয়ে উঠেছে অর্থনীতির একটি বড় সম্ভাবনা। প্রযুক্তির ক্রম উন্নয়ন এ প্রয়োজনীয়তাকে আরও বেশি অপরিহার্য করে তুলছে। সম্প্রচার, যোগাযোগ ও আবহাওয়াগত নানা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি মহাকাশ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি সুরক্ষা ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানেরও বড় মাধ্যম, যা সত্যিকার অর্থে রূপ নিয়েছে মহাকাশ বাণিজ্যে। আগামী ভবিষ্যতে মহাকাশ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্তার লাভ করবে। যেখানে স্বাভাবিকভাবে বিশ্বকে অতিক্রম করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয় সেখানে অত্যাধুনিক মহাকাশ প্রযুক্তির দ্বারা মহাকাশে পাঠানো যাত্রীবাহী যানের মাধ্যমে কম সময়ের মাধ্যমে এই বিশ্বকে অতিক্রম করা সম্ভব। এদিকে স্যাটেলাইট যোগাযোগ মাধ্যম সমগ্র বিশ্বজুড়ে একটি বৈশ্বিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করছে। এর ফলশ্রম্নতিতে বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার পাবে। বিশেষ করে যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই সেসব অঞ্চলেও পৌঁছাবে ইন্টারনেট। যার বদৌলতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দারুণ অগ্রগতি অর্জিত হবে। স্যাটেলাইটের প্রযুক্তির মাধ্যমে দেওয়া ব্রডব্যান্ড যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে অনেক সহজেই। মহাকাশ ভিত্তিক নেভিগেশনের মাধ্যমে ড্রোন ব্যবহার করে এক শহর থেকে আরেক শহরে যাতায়াত ও পণ্য পাঠানোও অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো ছবি ও তথ্যের ভিত্তিতে বর্তমানে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষক বুঝতে পারে কখন কীটনাশক বা সার দিতে হবে এবং কখন পানি দিতে হবে। অপরদিকে বিশেষ করে পৃথিবী থেকে মহাকাশ ঘুরে আসা মহাকাশ বীজ অন্য বীজ থেকে কয়েক গুণ বেশি উৎপাদনশীল। এতে করে কিছু কিছু বীজের খাদ্যশস্য পাকার সময় কমেছে। কিছু বীজের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে এবং কিছু কিছুর উৎপাদন পরিমাণ বেড়েছে কয়েক গুণ। মূলত মহাকাশের বীজ লালন করা অর্থাৎ মহাকাশের বীজ বলতে আসলে খাদ্যশস্যের বীজগুলো পৃথিবী থেকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার পর মহাকাশের বিশেষ পরিবেশের কারণে এই বীজগুলোর মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। তারপর সে বীজগুলো পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয় এবং নতুন প্রযুক্তিতে রোপণ করা হয়। ঐতিহ্যবাহী বীজের তুলনায় এসব বীজ থেকে নতুন ধরনের খাদ্যশস্য তৈরি হয়। তাদের গুণগত মানও অনেক ভালো হয়। বর্তমান বিশ্বের জন্য বড় একটি সংকট মিঠা পানি। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠানো ছবি এবং তথ্যের মাধ্যমে জানা যায় কোথায় পানির মজুদ রয়েছে। এছাড়াও পানি ও বায়ুদূষণ এবং মরুকরণ কোথায় হচ্ছে সেগুলো জেনেও দ্রম্নততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। অপরদিকে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অবৈধ আহরণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। প্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসের কারণ সনাক্ত করে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে বন্য পশু ও জীববৈচিত্র্যকে। আর এসবই প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার একদিকে যেমন বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রা মান বদলে দেবে তেমনি অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এভাবে ভবিষ্যৎ মহাকাশ গবেষণা আমাদের আরও নতুন নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করে দেবে। মো. জাহিদুল ইসলাম নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।