পশ্চাৎপদ মানসিকতা পরিহার করুন
বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা ও অন্য অপরাধের কারণে দ্রম্নততম সময়ে আইনভঙ্গকারীদের আইনের আওতায় আনা এবং কঠোর শাস্তি দ্রম্নততম সময়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করে এ ধরনের মানসিকতা পরিহার করা সম্ভব।
প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মো. মিনহাজুর রহমান মাহিম
কোনো ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা, মতাদর্শ, বিশ্বাস স্থাপনের জায়গা অনুযায়ী তার আচার-ব্যবহার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে তার মানসিকতা প্রকাশ পায়। সমাজে প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থাকে বা থাকতে পারে। তবে সমাজের মানুষের অনেক মতই রয়েছে, যা তারা আবশ্যকভাবে মেনে থাকে বা সবাই মিলে একই মতাদর্শ অনুসরণ করে থাকে। ওইসব মতাদর্শকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য মতাদর্শ বলে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মতাদর্শের মানুষ রয়েছে যারা সবাই মিলে একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য মতাদর্শ মেনে চলে। নির্দিষ্ট মতাদর্শের মানুষকে ভিন্ন করার জন্য আমরা জেনারেশনও বিভক্ত করে থাকি। একেক জেনারেশনের মানুষ একেকটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ মেনে চলে এবং তার আশপাশের মানুষেরও তা মেনে চলার জন্য নির্দেশ বা অনুরোধ করে থাকে। মতাদর্শ বা মানসিকতা নির্দিষ্ট করে মেনে চলা এবং নতুন মতাদর্শ গ্রহণে দ্বিধা প্রকাশ করা ব্যক্তিদের পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষ বলা হয়। পশ্চাৎপদ মানসিকতা সাধারণত পুরনো প্রজন্মের মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশের ২০০০ সালের আগের মানুষের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের হার, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা অত্যন্ত বেশিই দেখা যায় এবং যেত। যার কারণে তাদের মধ্যেই পশ্চাৎপদ মানসিকতা বেশি দেখা যায়। তারা পুরনো কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, নিয়মকানুন, রীতিনীতি মেনে চলে এবং নতুন কোনো মতামত বা নিয়ম সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য এবং সত্য ও সঠিক হলেও তা মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তাদের অধীনস্থ সবাইকে এ দ্বারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। সঠিক শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হওয়া, পরিবার ও পরিবেশগত প্রভাব ও মূল্যবোধের কারণে তারা পশ্চাৎপদ মানসিকতার হয়ে থাকে এবং এই মানসিকতা দ্বারা সবার ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে থাকে। পুরনো প্রজন্মের পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার মধ্যে নতুন মতবাদ গ্রহণে অনিচ্ছা, শিক্ষার অভাব, বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, নারীদের প্রতি বৈষম্য, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা এমনকি সাম্প্রদায়িকতাও দেখা যায়।
২০০০ সালের আগের মানুষের মধ্যে পুরনো মতবাদ বিরাজমান। শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন, বিজ্ঞানের নতুনত্ব, আধুনিকতার ছোঁয়ায় আধুনিক চিন্তাধারা গ্রহণে তারা অনীহা প্রকাশ করে এবং ঐতিহ্যগত রীতিনীতির ওপর জীবন পরিচালনা করতে চায়।
আমাদের দেশে ২০০০ সালের আগে শিক্ষার হারও তুলনামূলক অনেক কম ছিল বলা যায়। শিক্ষার হার কম থাকার কারণেও অনেকে এই পশ্চাৎপদ মানসিকতার হয়ে থাকে।
পশ্চাৎপদ মানসিকতার আরেকটি চরম বৈশিষ্ট্য হলো বাল্যবিবাহ। এখনো গ্রামাঞ্চলগুলোয় অহরহ বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। পশ্চাৎপদ মানসিকতা থেকে যতদিন সরে না আসবে ততদিন এই ব্যাধি চলতেই থাকবে।
যৌতুক প্রথা এই মানসিকতার মানুষের মধ্যে একটি কমন বৈশিষ্ট্য। যৌতুকের জন্য এখনো অনেক বিয়ে ভেঙে যায়, পারিবারিক কলহ এবং সংসারে অশান্তি চলতে থাকে।
নারীদের সব সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে না দেওয়া এই মানসিকতার মানুষের আরেকটি খারাপ বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের পুরুষদের থেকে কম সুবিধা দেওয়া এবং মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করানো এবং চাকরি না করার জন্য পরিবার থেকে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে নারীদের প্রতি বৈষম্য করাও এই মানসিকতার মানুষের বৈশিষ্ট্য।
এই মানসিকতার মানুষ প্রচুর অন্ধবিশ্বাস করে থাকে এবং কুসংস্কার মেনে থাকে। কোনো কিছুর ভিত্তি না থাকলেও ঐতিহ্য মেনে চলা ও সামাজিক নিয়মের সঙ্গে গা ভাসিয়ে অন্ধবিশ্বাস করে এবং কুসংস্কার ও কুরীতিনীতি মেনে থাকে।
ধর্মান্ধতা পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষের মধ্যে প্রচুর দেখা যায়। যেহেতু এই মানসিকতার মানুষ শিক্ষাগ্রহণ থেকে পিছিয়ে থাকে তাই পুরনো রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় আবেগ বেশি থাকে এবং ধর্মান্ধতার কারণে মাজার পূজাসহ নানা ধরনের কুধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে থাকে।
সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সমাজে একে-অপরের প্রতি বিবেধ, কলহ ও দাঙ্গা লাগানো এই মানসিকতার মানুষের একটি চরম খারাপ বৈশিষ্ট্য। এক ধর্মের মানুষের অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে না চলা, অন্য ধর্মকে অবজ্ঞা করা ও ক্ষতি করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে থাকে এই মানসিকতার মানুষ।
পশ্চাৎপদ মানসিকতার এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজে নানা ধরনের প্রভাব পড়ে থাকে।
সাধারণত তাদের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের অধীনস্থ অনেকেই প্রভাবিত হয়ে থাকেন এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা এর কারণে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।
নারীদের সঙ্গে বৈষম্য করার কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ে এবং সমাজের অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের বেড়ে ওঠায় বাধা সৃষ্টি হয়।
যেহেতু তারা নতুন মতবাদ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে, তাই তাদের জন্য অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজে বাধা সৃষ্টি হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে থাকে।
যৌতুক প্রথার কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে এবং সাংসারিক কলহ তৈরি হয়। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের কারণে অনেক মায়ের মৃতু্য, অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও শিশুর বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হয় এবং শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগে থাকে।
অন্ধবিশ্বাস, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার মেনে চলার কারণে সমাজে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান থাকে। আধুনিকায়ন থেকে মানুষ দূরে সরে যায় এবং নিজেদের ও আশপাশের মানুষের ক্ষতিসাধন করে থাকে।
আধুনিক চিকিৎসা থেকেও এই মানসিকতার মানুষ দূরে থাকে, যার কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। যা পরে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও হতে পারে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও সমাজে দাঙ্গা লাগানোর জন্য তারা প্রচন্ডভাবে দায়ী এবং তাদের এ কাজের কারণে সমাজের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধ ও যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি হয়ে থাকে।
পশ্চাৎপদ মানসিকতা পরিহারের জন্য সমাজে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বজনীন ও বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান আরোহণের মাধ্যমে পশ্চাৎপদ মানসিকতা পরিহার করা সম্ভব।
নারীদের যথাযোগ্য সম্মান করতে হবে। যৌতুক প্রথা বিলুপ্ত করতে হবে এবং বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নারীদের যেসব বিষয়ে ক্ষমতায়ন না করার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় সেসব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে হবে।
আধুনিক প্রযুক্তি ও চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এবং পুরনো রীতিনীতি পরিহারের মাধ্যমে এই মানসিকতা থেকে উঠে আসা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকার ও জনগণের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে।
সাম্প্রদায়িকতা থেকে সরে এসে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষ একত্রে মিলে বসবাস করতে হবে। একে-অপরের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে। কারও প্রতি বৈষম্য না করে সবার সঙ্গে একত্রে মিলে জীবনযাপন করতে হবে।
সবশেষে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই মানসিকতা থেকে সরে আসা সম্ভব এবং যারা এই মানসিকতার তাদের মধ্যে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা ও অন্য অপরাধের কারণে দ্রম্নততম সময়ে আইনভঙ্গকারীদের আইনের আওতায় আনা এবং কঠোর শাস্তি দ্রম্নততম সময়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করে এ ধরনের মানসিকতা পরিহার করা সম্ভব।
মো. মিনহাজুর রহমান মাহিম :কলাম লেখক