দিবস যায় দিবস আসে নিরাপদ হয় না সড়ক
সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা কোনো বিশাল সমস্যা নয়, যদি আমরা প্রত্যেকে প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি মেনে চলি এবং সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে অধিক সচেতন ও সতর্ক হই তাহলে তা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
তরিকুল ইসলাম
প্রতি বছর ২২ (অক্টোবর) ঢাকঢোল পিটিয়ে নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হয়। অথচ সড়কে প্রাণহানি কমছে না। দুর্ঘটনায় (রোডক্র্যাশ) পঙ্গু হয়ে মানুষ পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হচ্ছেন। এখন সড়ক যেন মৃতু্যফাঁদ। আতঙ্ক নিয়ে সড়কে নামতে হয়। পরিবার ও আপনজনদের কাছে ফিরতে পারব কি না, শঙ্কা জাগে! এমন দুঃস্বপ্ন বহুদিন বহুকাল ধরে তাড়া করছে। 'সড়ক দুর্ঘটনা বা রোডক্র্যাশ' আমাদের জাতীয় জীবনে বড় ধরনের একটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তৃণমূল থেকে উচ্চপর্যায় এ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হলেও কোথায় যেন একটা গলদ থেকে যাচ্ছে। অদৃশ্য একটা বলয় সব ইচ্ছার অপমৃতু্য ঘটাচ্ছে। এ কারণে সড়কের ভয়াবহতার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তাই বলতে হচ্ছে, 'দিবস যায় দিবস আসে নিরাপদ হয় না সড়ক'।
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২৪ এর প্রতিপদ্য বিষয়- 'ছাত্র-জনতার অঙ্গীকার, নিরাপদ সড়ক হোক সবার'। সড়কে কোনো শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরলে কেবল সড়ক নিরাপদ করার আন্দোলন গতি পায়। চলে কর্তৃপক্ষের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস ও আশার ফুলঝুরি। তারপর স্তিমিত হয়ে যায় সব। দিবস এলেও তা পোশাকি পালনের মধ্যেই থাকে সীমাবদ্ধ। আদতে সড়ক থেকে যাচ্ছে সেই অনিরাপদ। তবে আশা করছি, আগামীতে ছাত্র-জনতার হাত ধরে আমাদের সবার সচেতনতায় আমরা নিরাপদ সড়ক উপহার পাব। তার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত 'সড়ক নিরাপত্তা আইন'।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ প্রণয়ন। আইনে কিছু বিষয় স্পষ্ট হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। সেটি বিধিমালাতে হয়তো হতে পারে। যেমন- গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো গাইডলাইন আমাদের নেই। ফলে, যে যার মতো করে গতিসীমা বসিয়ে দিচ্ছি। গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য গাইডলাইন প্রয়োজন। এছাড়া হেলমেটের কথা বলা হলেও এর মানদন্ডের কোনো কথা বলা হয়নি। এছাড়া যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ও শিশুদের ক্ষেত্রে চাইল্ড রেস্ট্রেইন্ট বা শিশুদের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত আসন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আইনটিতে সংযোজন করা হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০২৩ সালে প্রকাশিত গেস্নাবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি অনুযায়ী রোডক্র্যাশে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ১০ লাখের অধিক মানুষ মারা যায়। যা প্রতি মিনিটে ২ জন ও প্রতিদিন ৩২০০ জনের বেশি যার বেশিরভাগই শিশু এবং উপার্জনক্ষম। রোডক্র্যাশে সারা বিশ্বে যত মানুষের মৃতু্য হয় তার প্রায় সবই (৯২ শতাংশ) বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে প্রায় ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃতু্য হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রতি লাখে রোডক্র্যাশে মৃতু্য ছিল ১৫.৩ এবং ২০২১ সালে এই মৃতু্য বেড়ে হয় প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ধারা ৩.৬ এবং ১১.২ এবং জাতিসংঘের বৈশ্বিক পরিকল্পনায় রোডক্র্যাশে মৃতু্য ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে- যা অর্জনে বাংলাদেশকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। যা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং প্রমাণভিত্তিক পন্থা সেইফ সিস্টেম এপ্রোচ এবং গেস্নাবাল পস্ন্যানের আওতাভুক্ত বিষয়সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন অতীব জরুরি।
সড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ : বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত গতি, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য বোঝাই, হেলমেট ও সিটবেল্ট না বাঁধার প্রবণতা, মাদকদ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালনা, চালক সহকারীর সহায়তায় গাড়ি চালানো, যান্ত্রিক ত্রম্নটি।
যাত্রীর নিরাপত্তায় সিটবেল্ট অপরিহার্য একটা বিষয়। যেসব দেশ সমন্বিত পরিকল্পনায় সড়ক দুর্ঘটনাকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পেরেছে, সেসব দেশে গাড়িতে সিটবেল্টের সঠিক ব্যবহারও একটি উপযোগী কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এবার আসা যাক, গাড়িতে শিশুদের আসন প্রসঙ্গে। গাড়িতে শিশুদের আসন যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে শিশুর মৃতু্যহার অনেক কমে আসবে। কারণ গাড়িতে যে আসন থাকে, তা প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী আসন। সেই আসনে শিশুদের বসানো হলে সিটবেল্টের যথাযথ প্রয়োগ কিংবা শিশুর শারীরিক কাঠামোগত উপযোগী নয়। ফলে, দুর্ঘটনা ঘটলে শিশুরা দ্রম্নত আসন থেকে ছিটকে পড়ে এবং মৃতু্যমুখে পতিত হয়। নিরাপদ ভ্রমণ ও যাত্রীদের নিরাপত্তায় জাতিসংঘ তাই শিশুদের আসনের গুরুত্ব তুলে ধরে সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচটি অতিঝুঁকিপূর্ণ কারণের মধ্যে শিশুর আসনকেও চিহ্নিত করেছে। আমাদের নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় সিটবেল্টের পাশাপাশি শিশু আসনের উপযোগিতা ও গুরুত্ব সমানভাবে স্থান পেতে হবে।
নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় আমাদের দেশে এখন প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে মোটর সাইকেল। নিত্য মোটর সাইকেলের দুর্ঘটনা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার প্রধান কারণ অল্প বয়সি চালক, উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের অভাব, বেপরোয়া গতি, একের অধিক যাত্রী, নিয়মকানুন না মানা, মানসম্পন্ন হেলমেট ও সঠিকভাবে পরিধান না করা। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও মাদক সেবন করে যানবাহন চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা কোনো বিশাল সমস্যা নয়, যদি আমরা প্রত্যেকে প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি মেনে চলি এবং সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে অধিক সচেতন ও সতর্ক হই তাহলে তা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বর্তমান আইন বা বিধিতে সড়ক অবকাঠামো, যানবাহনের নিরাপত্তা, সিটবেল্ট, শিশুনিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। নেশাগ্রস্ত ও মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো সংক্রান্ত বিষয়ে স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে উলেস্নখ নেই। দুর্ঘটনা পরবর্তী আহত ব্যক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত্র কোনো বিধান উলেস্নখ হয়নি। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে সহযোগিতার বিষয়ে সেবা প্রদানকারীদের আইনি সুরক্ষার বিষয়টি নেই। তাই এই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমার দাবি, সড়ক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের সমন্বয়ে বর্তমান আইনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পাঁচটি পিলারের আলোকে পৃথক 'সড়ক নিরাপত্তা আইন' প্রণয়ন করা হোক।
তরিকুল ইসলাম :কলাম লেখক