পাঠক মত
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে পদক্ষেপ নিন
প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
সাকিবুল হাছান সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা কলেজ, ঢাকা
মাদকের মরণ ছোবলে আক্রান্ত দেশের তরুণ ও যুবসমাজ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। বিনোদনমূলক এবং অচিকিৎসামূলক উদ্দেশ্যে ওষুধের ব্যবহারকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বলা হয়। যা কোকেন এবং মারিজুয়ানার মতো অবৈধ পদার্থের ব্যবহারকে বোঝায়, সেই সঙ্গে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ড্রাগস-অতিরিক্ত পরিমাণে বা অচিকিৎসামূলক উদ্দেশ্যে বোঝানো হয়। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উলেস্নখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। কিছু মেজাজ-পরিবর্তনকারী ওষুধ রয়েছে যা ঘুমকে প্রভাবিত করে। এই ওষুধ স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। গবেষকদের মতে, যে আসক্তিযুক্ত ওষুধ মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা বাড়ায়- একটি জৈব যৌগ যা স্নায়ু আবেগের সংক্রমণকে বাধা দেয়। যা শরীরের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। বাংলাদেশে শিশু-বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন-অসচেতন, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী কেউই মাদক থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদক, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ, এলএসডি, আফিম ও ইয়াবা ইত্যাদির অবাধ ব্যবহার। দেশে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখের ওপর, যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশই নারী। সমাজে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী। বিশাল সংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে আবার প্রায় ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- সমাজে কেন মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? কারণ হিসেবে বলা যায়, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, প্রেমে ব্যর্থতা, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা। এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে মাদকের। এ ছাড়া পারিবারিক অশান্তি, বন্ধু-বান্ধবের অসৎ প্রলোভন ও প্ররোচনা, অর্থের সংকট, এমনকি বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে মনোমালিন্য এবং ইসলামের সঠিক জ্ঞানের অভাব মাদকাসক্তির ঝুঁকি দিনদিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে মানসিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি শারীরিকভাবেও প্রভাবিত হয়। হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরে সব অঙ্গই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ মিলিয়ন মাদকাসক্ত রয়েছে। কারও কারও পরিসংখ্যানে এটা আরও বেশি। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত, ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। কারাগারে যারা অন্তরীণ আছে এর অধিকাংশ মাদক চোরাকারবারি কিংবা দীর্ঘদিন মাদক আদান-প্রদান করছেন। মাদকাসক্তি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাই মাদকের আগ্রাসন থেকে সমাজকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। আমাদের অবশ্যই মাদকসেবীদের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা ও সহযোগিতা সেবা জোরদার করতে হবে এবং তাদের ভুক্তভোগী হিসেবে চিকিৎসা দিতে হবে। মাদকসেবীদের সাজা ও বৈষম্য নয়, তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। মাদকের বিরুদ্ধে প্রথমে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষা, যথাযথ অনুশাসন এবং সচেতনতা খুবই জরুরি। দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও সঠিক শিক্ষা মাদক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, সৃজনশীল কর্মকান্ড ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাদক ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং চিকিৎসা কার্যক্রমের জন্য সহায়তা করার জন্য সরকার, এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে মাদক চোরাচালানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা ও অপরাধী হিসেবে না দেখে তারা কীভাবে, কাদের জন্য মাদকাসক্ত হচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই মাদকের ভয়ংকর ছোবল থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এখনই উচিত সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে মাদকবিরোধী মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। সর্বোপরি মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সাকিবুল হাছান
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা কলেজ, ঢাকা