দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতিরোধ করা যাচ্ছে না

দেশের সাধারণ জনগণ একমুখী সমস্যায় নেই। বহুমুখী সমস্যায় জড়িয়ে অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পাশাপাশি হয়তোবা অনেকে পরপারে চলে গেছেন। এর সমাধান সাধারণ জনগণের কাছে নেই। সদাশয় সরকারই পারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে।

প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

শতদল বড়ুয়া
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কোনোভাবে আপস মানতে চায় না। পূর্বে মানুষ দুইটা জিনিসের মূল্য বিষয়ে ভাবত। সেগুলো হলো- পেঁয়াজ এবং কাঁচা মরিচ। অনেকে আগে ভাগে ক্রয় করে সংরক্ষণ করত। এ বছর তা কিন্তু হয়নি। পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও কাঁচা মরিচের মূল্য প্রতিদিনই বাড়ছে। বর্তমানে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ডিম। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিলেও এখনো সাধারণ জনগণ দিশেহারা। কারণ বর্তমানে বাজারে প্রায় কাঁচা তরকারির দাম একশত টাকা ক্রস করেছে। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো তরকারির দাম একশত টাকার ওপরে। এ অবস্থায় বেশি বেকায়দায় আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকরা। তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মিলাতে পারছে না। যাক আমার প্রসঙ্গ ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিষয়ে। বাজারে গিয়ে মানুষ হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। সবকিছুর দাম আগের চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি। বাজার পরিদর্শনে গেলাম। নিজেরও কিছু সওদাপাতি আছে। একজন আরেকজনকে বলছে, কিরে ভাই! এভাবে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন? লোকটি বলল, বাজারে দ্রব্যমূল্যের চরিত্র পাল্টে গেছে। আজ বাজারে এসে দুশ্চিন্তায় ভুগছি। মাছ ছোটবড় কোনো কথা না, কোনো মাছ দুইশত টাকা কেজির নিচে নেই। আনুপাতিক হারে সবকিছুর দাম আপসহীন গতিতে চলছে। পূর্বে একশত টাকায় তিন কেজি পেঁয়াজ পেলেও বর্তমানে সেই পেঁয়াজ কেজি একশত দশ/বিশ টাকা। কাঁচা তরকারিও ওই একই পথের যাত্রী। একমাত্র আলু ব্যতিত অন্য সবকিছুর মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। আলুর দামও কেন জানি নড়ে চড়ে বসেছে। মুরগির মূল্যও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণহীন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশি বেকায়দায় পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। অভিজাত শ্রেণির মানুষ বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। নিম্নশ্রেণির মানুষ নো চিন্তা, ডু ফুর্তিতে আছে। থাকলে খেলাম, না থাকলে এত চিন্তা কীসে। কোমর বেঁধে পড়ে থাকলাম। তারা সব কাজ করতে পারে। মানসম্মানের ধার তারা ধারে না। যত সমস্যা মধ্যবিত্তদের। তারা না পারে সইতে, না পারে কইতে। ইতিহাসের আলোকে বলতে চাই, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত সমাজের জ্ঞান সাধনা, কর্ম সাধনা ও ভাব সাধনার গৌরবে রচিত হয়েছিল এই দেশের উজ্জ্বলতম ইতিহাস। মধ্যবিত্ত সমাজ ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের সৃষ্টি। লর্ড মেকলের পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশ বাণিজ্য এবং শনিচক্রের সমর্থক একদল প্রভাবশালী যুবক সৃষ্টির মাধ্যমে এই সমাজের উদ্ভব। এ দেশে নতুনতর সমাজ বিন্যাস শুরু হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনা থেকে। এই যুদ্ধের রাক্ষুসে দাবিতে শিল্প বাণিজ্যের নানা সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। যার কারণে কেউ ধনী, কেউ দরিদ্র হয়েছে। আজ সমাজের একদিকে, মেহনতি মানুষ; অন্যদিকে, বিলাসী ধনিক। দ্বিধাবিভক্ত সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থান কোথায়? এরা ধনী শ্রেণিভুক্ত নয়, পরিশ্রমীজীবীও নয়। এরা আত্মশ্রমে আপনাতে আপনি বিকশিত। কিন্তু সেই শ্রম কোনো দৈহিক শ্রম নয়, মানসিক শ্রম। তাই এরা মস্তিষ্কজীবী, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। বর্তমানের এ চড়া বাজারে মধ্যবিত্তরা প্রবেশ করতে পারছে না। মাসিক বেতন, মাসিক রোজগার সীমাবদ্ধের গন্ডি পেরুতে পারছে না। নীরবে-নিভৃতে চলছে মূল্যবৃদ্ধির গোপন ঘাতক। মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে ঠিকই, মধ্যবিত্তরা অর্থ সংকটে পড়ে অস্থির দিন যাপন করছে। এভাবে আর কত দিন চলবে আমরা কেউ জানি না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির সুবিধাভোগীরা। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো কাজের সফলতাও তেমন মিলছে না। খুচরা বিক্রেতার কথা একটাই, আমরা আড়ত থেকে এনে সামান্য লাভে বিক্রি করে কোনো প্রকারে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি। বিক্রেতারাও আড়তদারসহ উচ্চ মহলের কর্তাদের দায়ী করছে। তারা অধিক লাভের আশায় একজোটবদ্ধ। একই সুর সব আড়তদারদের। আমরা যেদিন যে দামে কিনি এর চেয়ে সামান্য ব্যবধানে বিক্রি করি। এবারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য আগে কোনো সময় বাড়েনি। বিক্রেতারা বলছে, আমরা আড়তে মাল পাচ্ছি না, যৎসামান্য যা আসে তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা অনেক ঊর্ধ্বে। আমরাও বেশ সংকটে আছি। আয় নেই, ব্যয় থামাতে পারছি না। একশ্রেণির মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ রয়েছে। তারা জিনিসপত্রের দাম নিয়ে এত মাতামাতি করে না, বিক্রেতা যা মূল্য চায় তা দিয়ে ক্রয় করে নিয়ে যায়। উপস্থিত একজনের এ মন্তব্য অন্যরা মানতে নারাজ। গাছ যেমন বড়, তার বাতাসও তেমন বেশি। যাক, আমরা এ বির্তকে যেতে চাই না। প্রকৃতি আমাদের তেমন সহায়ক নয় বলে চারদিকে মূল্যবৃদ্ধির মহড়া চলছে। দেশে সীমাহীন গরম। মাঠের ফসল তাপদাহে জ্বলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আরও জানা যায়, মূল্যবৃদ্ধির লাগাম এখনো থামানো যাবে না। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে বিদু্যৎ উৎপাদনে সংকট হচ্ছে। সাগরের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বাজারে গেলে বোঝা যায়, কীভাবে দ্রব্যমূল্য অস্থিরতায় রয়েছে। আনুপাতিক হারে কোনো দ্রব্য বাকি নেই দাম বাড়েনি। দেশের সাধারণ জনগণ একমুখী সমস্যায় নেই। বহুমুখী সমস্যায় জড়িয়ে অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পাশাপাশি হয়তোবা অনেকে পরপারে চলে গেছেন। এর সমাধান সাধারণ জনগণের কাছে নেই। সদাশয় সরকারই পারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে। যারা দায়িত্ব পালনে রয়েছে তারা যদি আন্তরিক না হয় তাহলে যেই লাউ, সেই কদুই থেকে যাবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সদা সতর্ক থাকা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তবুও আমরা আশায় বুক বাঁধি, এ সংকটের আয়ু অতি কম। নিয়মি ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মানুষের শ্রেণিভেদের কথা না ভেবে সবাইকে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। সরবরাহ পর্যাপ্ত হলে আপসহীন মূল্যবৃদ্ধি আপনাআপনি ধরাশায়ী হয়ে যাবে- এ মন্তব্য করলেন এক অর্থনীতিবিদ। আমরাও তার সঙ্গে একমত পোষণ করছি। আরও আশা করছি, প্রকৃতি যেন আমাদের সহায়ক হয়। শতদল বড়ুয়া : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক