সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি যৌক্তিক
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর ফলে দেশের লাখ লাখ বেকারের স্বপ্ন পূরণ হবে। তারা নতুন উদ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পড়াশোনা করবে।
প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
খন্দকার আপন হোসাইন
সরকারি চাকরি হতে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির জন্য কখনোই কোনো আন্দোলন হয়নি। হয়নি কোনো সভা সমাবেশ। স্স্নোগানে স্স্নোগানে রাজধানী প্রকম্পিত হয়নি। প্রেস ক্লাবের সামনে সম্মিলিত আমরণ অনশন হয়নি। পত্রপত্রিকায় লেখালেখির ঝড় ওঠেনি। তারপরও ২০১১ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসর গ্রহণের বয়স বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। একজন সরকারি চাকরিজীবীর অবসর গ্রহণের নির্দিষ্ট বয়স ছিল ৫৭ বছর। 'দি পাবলিক সার্ভিস (রিটায়ারমেন্ট) অ্যাক্ট-১৯৭৪' সংশোধন করে বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল।
২০১১ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিষয়ক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের পর থেকেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর জোর দাবি ওঠে। বিগত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির জন্য বহুবার আন্দোলন হয়েছে, অনশন হয়েছে এমনকি জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর জোরালো দাবি আমলে নেয় সরকার। একটি কমিটিও গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কমিটি বয়সসীমা বিষয়ক গবেষণা শেষ করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে কমিটির সুপারিশ কেবল সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির পক্ষেই না বরং অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির পক্ষেও। তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। শোনা যাচ্ছে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবসরের বয়সসীমাও বাড়তে পারে। অবসরের বয়সসীমা বাড়লে ত্রিশোর্ধ্ব চাকরিপ্রার্থীদের বস্তুত কোনো উপকার হবে না। অবসর গ্রহণের বয়সসীমা চার/পাঁচ বছর বাড়ানোর অর্থ আগামী চার/পাঁচ বছর কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরপ্রাপ্ত হবে না। ফলে, কোনো শূন্যপদ সৃষ্টি হবে না। শূন্যপদ সৃষ্টি না হলে বিসিএসসহ কোনো ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিই হবে না। চাকরিতে যাদের পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল পদ ফাঁকা না থাকায় তাদেরও পদোন্নতি হবে না। অবসরের বয়সসীমা বাড়ালে নির্দিষ্ট কিছু পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতিত কারোরই বিশেষ কোনো উপকার হবে না। কেননা, একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠান প্রধানের চাকরি আর চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারীর চাকরি এক না। বিশেষ করে যারা তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী কিংবা ১৫ গ্রেড থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারী তাদের জন্য অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি মোটেই সুখকর নয়। যে সব সরকারি কর্মচারী শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে থাকে তারা যত দ্রম্নত অবসরে যাবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল। তারা অবসরকালীন ভাতা দিয়ে বাকি জীবন পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আরামে কাটানোর চিন্তা করেই তাদের চাকরি জীবনের ইতি টেনে থাকে। একজন কর্মকর্তা যিনি সামাজিকভাবেও অত্যন্ত সম্মানজনক জীবনযাপন করেন তার জন্য অবসরের বয়সবৃদ্ধি লাভজনক হলেও নিচু স্তরের কর্মচারীদের জন্য নিতান্তই হতাশাজনক।
সরকারি চাকরি হতে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধির পক্ষে একটি যুক্তি হলো যে প্রার্থী ৩২ বছরে চাকরি শুরু করবে সে যদি অবসর গ্রহণ করে ৬১ বছর বয়সে অবসরে যায় তাহলে তার চাকরির সময়কাল সীমিত হয়ে যায়। অবসরের বয়সসীমা কেবল যেসব প্রার্থী সর্বোচ্চ বয়সসীমায় পৌঁছে চাকরি পাবে তাদের জন্যই কার্যকর হওয়া উচিত। কোনো অবস্থাতেই আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে চাকরিতে যোগদানকারী কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রে কার্যকর হওয়া উচিত নয়।
একজন সরকারি চাকরিজীবী তার চাকরিজীবনে একাধিকবার পদোন্নতি ও বছর বছর ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকে। ত্রিশ বছর কিংবা তারও অধিক সময় ধরে কর্মরত একজন সরকারি চাকরিজীবী শেষ সময়ে এসে যত টাকা স্যালারি ড্র করে সমপরিমাণ স্যালারিতে সমপদের নূ্যনতম তিনজন বেকার প্রার্থীর চাকরি নিশ্চিত করা সম্ভব। ৫৯ বছর থেকে শুরু কর পরবর্তী পাঁচ বছরে বয়স্ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে পরিমাণ টাকা স্যালারি দিতে হবে সমপরিমাণ টাকায় অর্ধলক্ষাধিক কর্মক্ষম মেধাবী বেকার তরুণের বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ডিস্টিংগুইশড ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমানের মতে অবসরের বয়সসীমা বাড়ালে অর্থনৈতিকভাবে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি চাপের মুখে পড়তে হবে। অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর ইমিডিয়েট এবং মিডিয়াম লং টার্ম ইফেক্ট আছে বলেও মনে করেন তিনি। অবসরের সময় বাড়ালে পেনশনের চাপ আরও বাড়বে। অবসরের সময় চার/পাঁচ বছর বাড়লে পেনশনের পরিমাণও সমানুপাতিকহারে বাড়বে। বাংলাদেশের বাজেটের বৃহৎ একটি অংশ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে একাশি হাজার পাঁচশত আশি কোটি টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল সাতাত্তর হাজার চারশত ঊননব্বই কোটি টাকা। সুতরাং, অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর প্রস্তাব মেনে নিলে সরকারকে এ খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে- যা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে উনিশ লাখ এক শত একাশিটি। এর মধ্যে শূন্যপদ আছে তিন লাখ সত্তর হাজার চারশত সাতচলিস্নশটি। আনুমানিক ষাট থেকে সত্তর হাজার চাকরিজীবী প্রতি বছর অবসরে যায়। অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হলে তারা আগামী চার/পাঁচ বছর অবসরে যাবে না। ফলে পদশূন্য না হলেও ধীরে ধীরে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। শুরু হবে অসম প্রতিযোগিতা। আবার আন্দোলন শুরু হবে। হবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির জন্য আন্দোলন। নতুনদের জন্য তখন নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে।
সার্বিক বিবেচনায় সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো মোটেই উচিত হবে না। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বাংলাদেশের তরুণ সমাজের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। বয়স বাড়ানোর ফলে যদি তরুণ বেকারদেরই কোনো উপকার না হয় তাহলে এই বয়সবৃদ্ধি কি কাজে আসবে? অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির আরেকটি যুক্তি দাড় করানো হয়েছে। যুক্তিটি হলো ন্যূনতম চাকরিকাল ২৫ বছর না হলে একজন চাকরিজীবী সম্পূর্ণ পেনশন পাবে না। একজন বেকার চাকরিপ্রার্থীর কাছে ভবিষ্যৎ পেনশনের চেয়ে চাকরিপ্রাপ্তিটাই বড় বিষয়। এছাড়া যদি পেনশনের কথা বিবেচনা করে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয় তবে যারা সরকারি/আধা সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পেনশনবিহীন চাকরি করে তাদের দুঃখের অন্ত থাকবে না। কিছু কিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পেনশনবঞ্চিত। তারাও যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে পেনশনপ্রাপ্তির আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে সরকারের ভ্রূক্ষেপ নেই।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর ফলে দেশের লাখ লাখ বেকারের স্বপ্ন পূরণ হবে। তারা নতুন উদ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পড়াশোনা করবে।
কিন্তু অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হলে লাখো বেকার তরুণের স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বন্ধ করে এই স্বপ্নাতুর তরুণদের মন ভেঙে দেওয়া রাষ্ট্রের উচিত হবে না।
খন্দকার আপন হোসাইন : গবেষক ও সংগঠক