প্রবীণদের প্রতি আমরা কতটা যত্নশীল এবং সচেতন
নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বয়স্কদের মধ্যে একাকিত্ব যেমন বাড়ছে, তেমনি অনেকের জন্য তৈরি হচ্ছে অসহায়ত্ব। আর এই অসহায়ত্বের সময় পাশে থাকা প্রতিটি সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
প্রকাশ | ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রশান্ত কুমার বর্মণ
ষাট বছর বয়সি কিংবা এর ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরা প্রবীণদের আওতাধীন। সমাজে তাদের অবস্থান সর্বাপেক্ষা উঁচুতে। তাদের সামাজিক সেবা, স্বাস্থ্যের যত্ন ছাড়াও অন্যান্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার গুরুত্ব কতটুকু তা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে প্রতিটি নাগরিকের ভাবা উচিত। কারণ বাংলাদেশের প্রবীণরা অন্য দেশের তুলনায় খুব কম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এ দেশের প্রবীণদের বেশিরভাগই অবনতিশীল স্বাস্থ্য, আর্থিক অসচ্ছলতা এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। কারণ অধিকাংশ বয়োবৃদ্ধের ছেলেমেয়েরাই তাদের পিতামাতার সঠিক ভরণপোষণ কিংবা আদরযত্ন করে না- যা সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী। ফলে, অবহেলিত হয় এমন হাজারো প্রবীণ। প্রবীণদের সত্যিকারের প্রাপ্য কি নিছক মিথ্যা? যেটা অন্তিম মুহূর্তে তারা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে আশা করে। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই কমবেশি প্রবীণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোথাও তারা সুখী নয়। শুধু শহরেই নয় বরং গ্রামেও অনেক বয়স্ক মা-বাবা তাদের সন্তানদের সঙ্গে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না নানান কারণে। তাই তো বৃদ্ধ অবস্থায় পিতামাতাকে সন্তানের কাছ থেকে সুরক্ষা দিতে সরকার ২০১৩ সালে 'পিতামাতার ভরণপোষণ আইন' প্রণয়ন করেন। সেখানে ভরণপোষণের ব্যতিক্রমে শাস্তির বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী কোনো সন্তান তার পিতামাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রবীণ নিবাস বা অন্য কোনো জায়গায় বসবাস করার জন্য জোরপূর্বক কোনো কিছুতে বাধ্য করতে পারবে না। সন্তানরা যদি এসব দায়িত্ব পালন না করে তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এক বিশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটির বেশি প্রবীণ আছে- যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের মতে, আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান দেশ হবে। বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান সমাজে পদার্পণ করবে ২০২৯ সালে এবং ধীরে ধীরে তা বাড়তেই থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বে প্রতি ৬ জনের একজন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবীণরা নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বয়স বৈষম্যবাদ কিংবা বয়সের ওপর ভিত্তি করে নেতিবাচক ধ্যানধারণায় আটকে থাকার কারণে এমন বৈষম্য দেখা দেয়। তারপরও অনেকে দারিদ্র্য, আত্মকেন্দ্রিকতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কারণে প্রবীণদের প্রতি যথাযথ আচরণ করে না। বর্তমান তরুণ-তরুণীরাও ভবিষ্যতে প্রবীণ হবে। তাই তাদের সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরাও সমপরিমাণ আশা করতে পারব। আশ্রয়হীন ও স্বজনহীন প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা হয়েছে। সরকারের প্রবীণ ব্যক্তির কল্যাণ, অধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমূহের মধ্য ১৯৯৭-৯৮ এ প্রথম বয়স্কভাতা, ২০১৪ সনে বয়স্কদের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ঘোষণা, ৮ বিভাগে আটটি বৃদ্ধাশ্রম, প্রবীণ সেবা কর্ণার, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা গঠন করেন।
জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তারা নানামাত্রিক সমস্যায় পড়ে। কিন্তু যদিও খাতা-কলমে তাদের অধিকার সংরক্ষিত, তবে বাস্তবে তার কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেই প্রবীণরা পরিবার ছাড়াও সমাজে তারা অবহেলিত ও বঞ্চনার শিকার হন। তারা গণ্য হন বাড়তি বোঝা হিসেবে। পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ও পশ্চিমা সমাজব্যবস্থার প্রভাবে এখন অনেক প্রবীণ বোঝা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই হতভাগ্য হয়ে তারা শেষ বয়সে ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করছে। সময়ের সঙ্গে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, চাকরিরত ও অন্যান্য কারণে প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যমন্ডিত যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা ফাটল তৈরি হচ্ছে। যারা অবসরে যাচ্ছেন তারা কোথায় থাকবেন। একটা বাসায় একা একা থাকা কতটা নিরাপদ? প্রতিটি উপজেলায় এজন্য প্রবীণ নিবাস প্রয়োজন। সেখানকার প্রবীণরা চিকিৎসা, খাওয়া ও নিরাপদ পরিবেশে দিনাতিপাত করতে পারবে। কোনো চাকরি থেকে অবসর নিলে তাদের অর্থ উপার্জনের কোনো উৎস থাকে না। তাই তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা আজ তুচ্ছতাচ্ছিল্য। প্রতিনিয়ত আমরা তাদের ওপর বিভিন্ন অমানসিক নির্যাতন ও ব্যভিচারের সাক্ষী হচ্ছি- যা কল্পনাতীত। আমরা রাস্তাঘাটে বের হলেই এগুলোর কোনো না কোনো ঘটনা আমাদের চোখে পড়ে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের সন্তানদের মানুষ করলেও শেষ বয়সে তাদের টাকায় পিতামাতার অন্ন জুটে না কিংবা স্ত্রীদের প্ররোচনায় তারা এমন বিমাতাসুলভ আচরণ করতে বাধ্য হয়। তারাও একদিন বৃদ্ধ হবে তখন তাদের স্থান হবে ঠিক এমনই- যেমনটা এখন তারা করছে তাদের পিতামাতার সঙ্গে। গ্রাম কিংবা শহরে সচ্ছল প্রবীণরা পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন, কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের এদের স্থান যথারীতি ভিন্ন। বাজার করা, নাতি-নাতনিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, পড়ানো ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। অধিকাংশ প্রবীণই পুরোপুরিভাবে সন্তানদের ওপর নির্ভরশীল। সন্তানদের অবহেলা কিংবা তাদের ছেলের বৌদের অবহেলার কারণে তারা বিনা চিকিৎসা মৃতু্যবরণ করে কিংবা শেষ অবধি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কিন্তু তারা তাদের বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় করেছে নিজ পরিবার গঠন, সন্তানদের শিক্ষিত করতে এবং সমাজ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতি ও উন্নতিতে।
প্রবীণদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা ও নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। এসব সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের বাকি জীবনটা সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে কাটানোর সুযোগ করে দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসার আহ্বান করছি। বিশ্বের প্রায় সব দেশে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদেরই শ্রম ও ত্যাগে আমাদের ভিত্তি মজবুত হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে বয়স্কভাতা প্রবর্তন করেন- যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর বহুসংখ্যক প্রবীণদের বয়স্কভাতা প্রদান করা হয়। আজকের প্রবীণরাই ছিল অতীতে দক্ষ কারিগর এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠী দেশের বোঝা নয়, বরং আমাদেরই জনসংখ্যা এবং সম্পদ। সরকারের গৃহীত বয়স্কভাতা প্রশংসার দাবিদার। উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা, যাতায়াত, চিকিৎসাসেবা, বৃদ্ধা নিবাস এখনো সঠিকভাবে গড়ে উঠেনি। তবে তার পরিমাণ অনেক কম। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুস্থ সবল মেধা ও অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে লাগানো যেতে পারে। যেহেতু তারা অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাংলাদেশের প্রবীণদের সহনশীলতা বাড়াতে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। প্রবীণদের জন্য চারটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ : স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, সমবয়সিদের সাহচার্যপ্রাপ্ত এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।
নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বয়স্কদের মধ্যে একাকিত্ব যেমন বাড়ছে তেমনি অনেকের জন্য তৈরি হচ্ছে অসহায়ত্ব। আর এই অসহায়ত্বের সময় পাশে থাকা প্রতিটি সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। প্রবীণদের অধিকার সমুন্নত রাখা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রবীণ নীতিমালা প্রণয়নসহ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ অতি আবশ্যক।
প্রশান্ত কুমার বর্মণ : কলাম লেখক