সম্প্রতি সরকার পূর্বের আটটি জাতীয় দিবস বাতিল করেছে। এই আটটি দিবস হলো- ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস ১৭ মার্চ, ৫ আগস্ট ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর মৃতু্যবার্ষিকী, ১৮ অক্টোবর শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেলের জন্মদিন, ৮ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস, ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস। ১৫ আগস্টের বেলায় বলা হয়েছে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত আদেশ সাপেক্ষে দিনটি উদযাপন/পালনের বিষয়ে না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই আটটি দিবস বাংলাদেশের নাগরিকের বা বাংলাদেশ জন্ম বা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার বিশদ ব্যাখ্যার দরকার। অপ্রয়োজনীয় দিবস পালন করাটা অযৌক্তিক আবার গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি বাদ দিলে জাতি সৃষ্টির মূল ধারা থেকে সরে আসবে- যা হবে পূর্বসূরিদের সঙ্গে বেইমানির শামিল। যেমন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্ম দিনটি জাতীয়ভাবে পালন করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সহর্ধমিণী। জাতীয় প্রেক্ষাপট তৈরিতে তার অবদান কতটুকু, সেই বিষয়টা বিচার করে এই জন্মদিনটা জাতীয় দিবস ঘোষণা দেওয়াটা উচিত ছিল, যেহেতু আগের সরকার তা করেনি তাই এই দিনটি জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ দিলে জনমনে কোনো ক্ষোভের সঞ্চার হবে না। ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিনটাও জাতীয় দিবসে পরিণত করাটা উচিত হয়নি। শেখ রাসেলের জন্মদিনটা জাতীয় দিবস করাটা আদৌ কি প্রয়োজন ছিল, তারপরও শেখ হাসিনা সরকার আবেগে প্রলুব্ধ হয়ে এটা জাতীয় দিবসে পরিণত করে- যার কোনো যুক্তিকথা নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়ে ওই দিনটাকে জাতীয় দিবস করা একটা হাস্যকর বিষয়। এ ধরনের হাস্যকর বিষয়গুলো তৈরি করেছে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার। কতগুলো অযৌক্তিক বিষয়কে জাতীয় দিবস বানানোর জন্য হাসিনা সরকারে আমলের গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোকে বাদ দিতে পারছে অন্তর্বর্তী ইউনূস সরকার। ৭ মার্চ, এই দিনটি ঐতিহাসিক- কারণ এই দিনটি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টির ঘোষণা হয়; এটা ধরে নিলে ভুল হবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা যারা শুনেছেন, তারা অবশ্যই বলবেন যে, এই ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণাটা নিহিত আছে। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ৭ মার্চ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় জীবনে যে, এই ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতি হাজার বছরের পরাধীনতার শিকলটা ছিঁড়তে পেরেছিল। বাংলাদেশ নামক জনপদটি কত বছর বা কতকাল পরাধীন ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যন জানাটা এখন কষ্টকর। কারণ নবাব আলীবর্দী খাঁ বা মোগলরা বাঙালি বা বাংলা জনপদের কোনো মানুষ ছিলেন না। তাই তাদের শাসনামলকে স্বাধীন বাংলার শাসন বলা যায় না। নবাবদের হাত থেকে দেশের শাসনভার চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ইংরেজদের হাত থেকে হাত বদল হয়ে যায় পাকিস্তানিদের কাছে। সর্বশেষ পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশ উদ্ধার করা হয় অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ছয় দফা- যা ১৯৬৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু লাহোরে ঘোষণা করেছিলেন। ছয় দফার ভিত্তিতে এ দেশের মানুষ মুক্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে থাকে আর এর চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ৭ মার্চে ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে শব্দগুলো ব্যক্ত করেন তার পথ বেয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দ্রম্নত সংগঠিত হয়। ৭ মার্চের ভাষণের কারণেই সংগঠিত হয়েছিল নিপীড়িত, নির্যাতিত, সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধায় আর মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালায় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়। তাই ঐতিহাসিক ৭ মার্চকে বর্জন করা জাতির মূল শেকড় থেকে সরে আসার শামিল। স্বৈরশাসক হাসিনা আর ৭ মার্চ একসূত্রে গাঁথা না। ৭ মার্চ ভাষণের শব্দগুলোতে গণতান্ত্রিক বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন, কেউ যদি নায্য কথা বলে, তারা সংখ্যায় একজন হলেও আমি মেনে নেব। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিটি মানুষের কথার মূল্য দেওয়া উচিত। গণতন্ত্রে পরমত সহিষ্ণুতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ- যা ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ব্যক্ত কথামালায় রয়েছে। শেখ হাসিনা এ দেশের গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিলেন। তাই তার সঙ্গে ৭ মার্চকে তুলনা করাটা ঠিক না। ৭ মার্চ ছিল একটি ঐতিহাসিক সার্বজনীন দাবি পূরণের পথ সূচনার দিন। এই দিবসটি বাতিল করাটা সঠিক হবে না। এটা বাতিল হলে বাংলা জনপদের মানুষের মনের ভেতরে বিশাল ক্ষোভের সঞ্চার হবে। কারণ ৭ মার্চকে জাতি ধরে নেয় এটাই স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্বাংশ। ৭ মার্চের ভাষণের ওপর ভিত্তি করেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। আধুনিক পৃথিবীর পরাধীনতার শেকল ভাঙার যে কয়েকটি ভাষণ আছে সবকটির ঊর্ধ্বে এবং গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে। পৃথিবীতে যে জাতিগুলো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে তার মধ্যে বাঙালি জাতি অন্যতম। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার যে ভাষণগুলো বিশ্বে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে সুসংগঠিত সংগ্রামী ভাষণটি হলো ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু দেওয়া ভাষণটি। এই অগ্নিঝরা ভাষণের প্রতিটি শব্দ আজো গেথে আছে বাঙালির হৃদয়ে। ৭ মার্চের ভাষণে প্রদত্ত শব্দগুলো বাঙালির জীবনে এক মুক্তির কবিতা। এই দ্রোহ দেশপ্রেমের কবিতাটিকে বুকে ধারণ করে বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তির সংগ্রামে। সুতরাং, ৭ মার্চের বক্তৃতা বাংলা জনপদজুড়ে সেদিন তৈরি করেছিল এক সংগ্রামী শপথ। বাংলা জনপদের মানুষের ওই অগ্নি শপথের শানিত বাণের আঘাতে, পালিয়ে গিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের সেরা সেনাবাহিনী সদস্য পাকিস্তানিরা। তাই জাতীয় দিবস থেকে ৭ মার্চকে বাদ দেওয়াটা সঠিক হবে না। যদি দেওয়া হয় তাহলে তা হবে দেশ ও জাতির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শামিল। ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন। পৃথিবীর বহু দেশে জাতির জনকের জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে পালন করে। কারণ জাতি চায় দেশের প্রতিটি শিশুই হয়ে উঠুক জাতির জনকের ন্যায় নির্লোভ, সৎনিষ্ঠ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী। প্রতিটি শিশুই বেড়ে উঠুক তার দেশপ্রেমকে লালন করে। তাই জাতির জনকের জন্ম দিনটিকে পালন করা হয় জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে। বাংলাদেশে সেই সূত্রে ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে জাতির জনকের জন্মদিনটা পালিত হয়ে আসছে।
১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুর জঘ্যতম হত্যাকান্ড। ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবার আত্মীয়স্বজন, ভাইবোনসহ প্রায় শতাধিক মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়। যে মানুষটি হাজার বছরের পরাধীন বাংলাকে মুক্ত করে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটির মানচিত্র স্থাপন করেছিলেন তাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করাটা সভ্য দুনিয়া মেনে নেয়নি। তাই এই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন জনপদকে মেনে নিলে কেউ এই হত্যাকান্ডের পক্ষে কথা বলতে পারে না। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ তার নেতৃত্বেই বাংলা জনপদটি পৃথিবীর মাঝে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাই এই মহান বাঙালিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে বিবেচনা করাটা জাতির উচিত।
দেশের বর্তমান সরকারপ্রধান, একজন কীর্তিমান নোবেলজয়ী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, সুশিক্ষিত ও আন্তর্জাতিক জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি সব পরশ্রী কাতরতার ঊর্ধ্বে ওঠে বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন, এটাই আশা করছে দেশবাসী।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক