শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

আনুপাতিক ভোটের পক্ষের-বিপক্ষের উদ্বেগ

প্রায় পঞ্চাশ বছরের সংঘাতময় রাজনীতির পর এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য একটি বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উত্তরণ খুবই প্রয়োজন।
মোহাম্মদ আবু নোমান
  ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আনুপাতিক ভোটের পক্ষের-বিপক্ষের উদ্বেগ

আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আসন বণ্টনটা কীভাবে হবে? নির্দিষ্ট কোনো আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও মোট ভোটের ১০ ভাগ ভোট পেয়ে কোনো দল যদি ৩০টি আসন পায়, সেক্ষেত্রে তাদের কোন আসনগুলো দেওয়া হবে? যে আসন তাদের বণ্টন করা হবে সেখানে তাদের ভোট যদি ১০ ভাগ বা তারও কম হয়, তাহলে সেখানে বাকি ৯০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধি থাকল কোথায়? এ বিষয়ে ভাবতে হবে। এরকম হলে তো মানুষ আর ভোট দেওয়ার আগ্রহ পাবে না। কোনো সংসদীয় আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোট দেবে এক দলকে, আর বণ্টনের ফাঁদে পড়ে তাদের এমপি হবে অন্য দলের/ এলাকার কেউ! এরকম কিছু বাংলাদেশের ভোটাররা মোটেও ভালোভাবে গ্রহণ করবে কী?

জনপরিসরে নতুন নির্বাচনপদ্ধতির বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো এ বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি। ভবিষ্যতে দেশ কোন দিকে এবং কী ধারায় অগ্রসর হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। দেশে যাতে একনায়কত্বের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাবও উত্থাপিত হচ্ছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ আনুপাতিক ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার পক্ষে, আবার এর বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থানও আছে অনেকেরই। সে যাই হোক, আমাদের দেশের চলমান 'দ্বিদলীয়' রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে, দেশে সত্যিকার শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

আনুপাতিক পদ্ধতিতে মানুষ ব্যক্তিকে নয়, ভোট দেবে দলীয় প্রতীকে এবং সারাদেশে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবিত তালিকা অনুযায়ী। অনেকেই বলছেন, দেশের বিদ্যমান নির্বাচনপদ্ধতি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর ও সর্বোত্তম পন্থা। বাংলাদেশের এখনকার নির্বাচনী ব্যবস্থায় একজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের চেয়ে কম পেয়েও জিততে পারেন; যখন তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিভিন্ন মার্কায় বিভক্ত থাকেন। ধরা যাক, একজন প্রার্থী কাস্ট হওয়া ১ লাখ ভোটের ৪০ হাজার পেলেন, আর তার তিন প্রতিদ্বন্দ্বী মিলে ৬০ হাজার (২৫+২০+১৫) ভোট পেলেন। এ রকম ক্ষেত্রে প্রথমজন জয়ী হয়েছেন বলেই ধরা হয়। এতে জাতীয় পার্লামেন্টে ওই নির্বাচনী এলাকার যিনি প্রতিনিধি হন, তিনি আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দের ও বাছাইকৃত নন।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না-ও পারে। প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে ভাগে পড়া আসনগুলোতে দলীয় প্রধান বা দলের কেন্দ্রীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হবেন।

যারা আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে তারা আমাদের পাশ্বর্বর্তী দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কার দৃষ্টান্ত টানছেন। আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় নেপাল কিন্তু সুফল পায়নি। নড়বড়ে সরকার গঠিত হওয়ার ফলে ছোট দলগুলোর চাপে বারবার প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। নেপালে গত ১০ বছরে ৯ জন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়েছে। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের ফলে নেপালে এখন পর্যন্ত কোনো স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। অথচ একটি দেশের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল সরকার থাকা জরুরি।

শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো অনুন্নত ছোট দেশের উদাহরণ আমরা কেন টানব? যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রিটেন, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো বৃহৎ/উন্নত দেশের উদাহরণ টানা যেতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের দেশে নির্বাচন আমাদের দেশের সার্বিক বিবেচনা ও পটভূমিতেই করা উচিত। মূল কথা হলো, জনগণের সঠিক ভোটাধিকারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বাকস্বাধীনতা বজায় রাখা ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বহাল রাখা হলে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবে হবে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মতো ছোট ও সংঘাতপূর্ণ দেশে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হলে, এ দেশ বিশ্ব মোড়লদের দাবা খেলার গুটিতে পরিণত হবে কিনা ভাবতে হবে। যেমনিভাবে শ্রীলঙ্কা ও নেপালকে নিয়ে ভারত ও চীন খেলছে। বাংলাদেশকে নিয়ে কিন্তু চীন ও ভারতই খেলবে না, আমেরিকা ও রাশিয়াও খেলবে!

আমাদের দেশে পার্টি প্রধান যে সিদ্ধান্ত দেন দলের সবাই তা মেনে নেন। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে দলীয় প্রধান অনৈতিক লেনদেন বা তার আত্মীয়, চামচা ইত্যাদিদের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে তাতে ভালো নেতা হিসেবে যারা পরিচিত তারা বঞ্চিত হবেন এবং দুর্নীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। দলের নেতাদের হাতে সব ক্ষমতা চলে যাবে। এমনও হতে পারে বাণিজ্য বিনিময়ে তারা নির্ধারণ করবেন কে নেতা হবে। আমাদের জাতীয় সংসদে নারী কোটায় সদস্য নির্বাচিত হন সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বেও ভিত্তিতে। ফলে, দলের নেতাদের স্ত্রীদেরও এ কোটায় সংসদ সদস্য হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য সুযোগ তৈরি হয়- যা স্পষ্টতই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার চরম অপব্যবহার। মনোনয়নের ক্ষমতা একক কর্তৃত্বে কেন্দ্রীভূত থাকার মাজেজা আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করেছি।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবর্তে ভোটের আনুপাতিক হারে বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। তবে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এই পদ্ধতি চায় না। তারা বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। আর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কোনো ওপেনিয়ন এখনো জানা সম্ভব হয়নি।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এটা অনুমান করা যায়, চলতি ব্যবস্থা বহাল থাকলে আসন্ন ভোটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। জনসমর্থন ও সাংগঠনিকভাবে তারা অন্য দলগুলোর চেয়ে এখন এগিয়ে আছে। তবে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলো চাইছে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন। এমনকি বিএনপির অনেক পুরনো জোট-সহযোগীও ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন চায়। তবে এ ধরনের সংস্কারে আওয়ামী লীগও ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে, যদি তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দেওয়া না হয়। এ মুহূর্তে পুরনো আসনভিত্তিক ভোটে নৌকা মার্কার পক্ষে অনেক জায়গায় প্রার্থী হতে গিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারেন দলের প্রার্থীরা। কিন্তু আনুপাতিক পদ্ধতিতে জাতীয়ভাবে কেবল মার্কাকে সামনে রেখে ভোট হলে আওয়ামী লীগ তাদের এখনকার সাংগঠনিক সংকট এড়িয়ে যেতে অনেকটা সক্ষম হবে।

গত ১২ অক্টোবর রাজধানীতে এক সেমিনারে বিএনপি ব্যতিত সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণ-সংহতি আন্দোলন ও গণ-অধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে নিজেদের মত দেয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৭ সালে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেই আলোচনায় জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিপস্নবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) কিছু দল এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছিল।

সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী তাদের সংস্কার প্রস্তাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছে। দেশের ছোট দলগুলোর আনুপাতিক নির্বাচন চাওয়ার কারণ হলো, তাদের সক্ষমতা নেই দল থেকে বর্তমান পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে প্রতিনিধি পাঠানো। প্রতিটি আসনে তাদের ভোট সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে ছোট নিবন্ধিত দলগুলো বড় দলগুলোর সঙ্গে এঁটে আসতে পারবে না। তাই ছোট দলগুলো আনুপাতিক হারে নির্বাচন চাইছে। জামায়াতে ইসলামীকে মনে রাখতে হবে '৭১-এ তাদের ভয়ংকর ভুল, '৯০-এর দশকে এরশাদের সহযাত্রী হয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ভুল, '৯৬-এর রাজনৈতিক ভুলের পর '২৪-এ যদি জাতীয় পার্টি, বাম আর আওয়ামী লীগের চাওয়ার সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ান, তাহলে আপনারা আরেক ইতিহাস হয়ে থাকবেন।

আমরা জানি, বর্তমান পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থায় বিগত দিনে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ সবাইকে স্বৈরাচারী তকমা নিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলছেন, স্বৈরাচারী হওয়ার পথ ঠেকানোর রাস্তা হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। কারণ, এই পদ্ধতিতে ভোট হলে কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিগত নির্বাচনগুলোতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যারাই পেয়েছে, তারা নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করেছে। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সর্বসম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হবে না। আর আবশ্যিকভাবে সংসদে শক্ত বিরোধী দল থাকবে।

কেউ কেউ বলছেন, আনুপাতিক নির্বাচন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার একটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের পথ যে সুগম হবে। ভোটের শতাংশের হিসাবে আওয়ামী লীগ সংসদে যত আসন পেতে পারে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় তার তুলনায় যে সাফল্যের সম্ভাবনা নগণ্য হবে, তা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আমরা বলতে রাখতে চাই, আনুপাতিক ভোটের মাধ্যমে যদি নির্বাচন গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়, সে ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধী, ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের আইনানুগ ব্যবস্থায় তাদের জনপ্রতিনিধি হওয়া অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।

\হপ্রায় পঞ্চাশ বছরের সংঘাতময় রাজনীতির পর এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য একটি বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উত্তরণ খুবই প্রয়োজন।

মোহাম্মদ আবু নোমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে