মা ইলিশের সঠিক প্রজনন ও বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষায় সরকার ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত মোট ২২ দিন প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ সময়ে মা ইলিশ আহরণ, পরিবহণ, বিপণন ও মজুত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। মা ইলিশের বিচরণ ও অভিপ্রায়ণ নিরাপদকরণসহ অবাধ প্রজননের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইলিশের প্রবৃদ্ধি অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে মৎস্য নৌযানসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক ট্রলার কর্তৃক সমুদ্র উপকূল ও মোহনায় মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ এবং ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাগর ও নদী দুই জায়গায়ই ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র। ইলিশ পছন্দ করে না, এমন বাঙালি দেশে ও বিদেশে খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। ইলিশ স্বাদে ও গুণে সত্যিই অতুলনীয়। সরষে ইলিশ দেখলে সব বাঙালির জিহ্বায় পানি চলে আসে। বিগত বছরগুলোতে ইলিশ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল এবং এমন প্রেক্ষাপটে মা ইলিশ শিকারের ওপর অবরোধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন বেশ উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাছে-ভাতে বাঙালি যেন তার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে।
মা ইলিশ মূলত বছরে দু'বার ডিম দেয়। অধিকাংশরা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এবং বাকিরা ফেব্রম্নয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল মাসে। একটি মা ইলিশ প্রতি মৌসুমে একবারে সর্ব্বোচ্চ ১ থেকে ২.৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ থেকে ২৩ লাখ পরিমাণে ডিম দেয় এবং নার্সিং গ্রাউন্ডে সারাক্ষণ ডিমের পরিচর্যা করে। সদ্য প্রসূত ডিমগুলোকে শত্রম্নর হাত থেকে বাঁচাতে কখনো কখনো তা মুখে পুরে সঙ্গে নিয়েও ঘুরে বেড়ায়। ডিম থেকে বাচ্চা না ফোটা ও সাঁতার শেখা পর্যন্ত মা ইলিশের পরিচর্যা চলতে থাকে। সাঁতার দেওয়ার উপযোগী হয়ে উঠলে বাচ্চারা মা ইলিশের সঙ্গে সাঁতার কেটে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। ইলিশের বাচ্চা লালনপালনে বাবা ইলিশও ভূমিকা রাখে। মা ইলিশ যখন বাচ্চাদের রেখে খাদ্যান্বেষণে যায় তখন বাবা ইলিশ তাদের দেখাশোনা করে।
এত পরিচর্যার পরও মাত্র ১০-২০ শতাংশ জাটকা সমুদ্রের নোনা পানিতে সঠিকভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। কারণ ডিমের প্রায় ৩০ শতাংশ অন্য মাছ ও প্রাণিদের আহারে চলে যায়। ১০ শতাংশ অপুষ্ঠিজনিত কারণে শুরুতেই নষ্ট হয়ে যায়। পরে প্রায় ২০ শতাংশ পোনা এবং ৩০ শতাংশ জাটকা হিসেবে জেলেদের জালে ধরা পড়ে। বলা হয়, যদি ৫০ শতাংশ ডিমও যথার্থভাবে বেড়ে উঠতে পারত তাহলে বিভিন্ন নদী অববাহিকা ও বঙ্গোপসাগরের অর্ধেকটা ইলিশের দখলে চলে যেত।
ইলিশের পোনা ৬ থেকে ১০ সপ্তাহে ১২ সেমি থেকে ২০ সেমি পর্যন্ত বড় হয়। তখন তাদের জাটকা বলে। একটি জাটকা মাছ পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হতে সময় নেয় ১ থেকে ২ বছর। তখন আয়তনে ৩২ সেমি থেকে ৬০ সেমি এবং ওজনে ১ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। জাটকারা মা ইলিশের সঙ্গে সমুদ্রে চলে যায়। সেখানে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হয়ে আবার প্রজননকালে নদীতে ফিরে আসে।
মা ইলিশের সংরক্ষণ ও সঠিক প্রজননের জন্য সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতি বছরের ন্যায় চলতি মাসের ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহণ নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এ সময় মা ইলিশ ৮০ শতাংশ ডিম দেয়। তারা ডিম দেয় মূলত মিঠাপানিতে। তাই আশ্বিনের পূর্ণিমার চার দিন আগে এবং পূর্ণিমার পর ১৮ দিন মোট ২২ দিন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, নদীর মোহনাসহ যেসব জেলা ও নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়, সেখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। এর আগে একসঙ্গে টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম দুটি- সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (ভাদ্র মাস থেকে মধ্য কার্তিক) ও জানুয়ারি থেকে ফেব্রম্নয়ারি (মধ্য পৌষ থেকে মধ্য ফাল্গুন) হলেও দ্বিতীয় মৌসুমের তুলনায় প্রথম মৌসুমে প্রজনন হার বেশি।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছে, বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে ইলিশের গতিপথ। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেলে নদীতে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে ইলিশের আমদানিও বাড়ে। দ্য প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিস রুলস ১৯৮৫ সংশোধন করে ৬টি ইলিশ অভয়াশ্রম ঘোষণা করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৬৫ দিনে যে পাঁচটি অভয়াশ্রমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে সেগুলো হচ্ছে- ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালীর চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা, চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্ণীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ ও বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর, গজারিয়া ও মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকা, ভোলার মদনপুর, চর ইলিশা থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা এবং শরীয়তপুরের নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং চাঁদপুরের মতলব উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা। প্রতি বছর মার্চ ও এপ্রিল, এই দুই মাস উলিস্নখিত অভয়াশ্রমে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকে। এ সময় সংশ্লিষ্ট ছয়টি জেলার তালিকাভুক্ত জেলের জন্য মাসে ৪০ কেজি করে দুই মাসে সহায়তা দেয় সরকার। এ নিষেধাজ্ঞার সময় ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রের অন্তর্গত ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধসহ দেশব্যাপী পরিবহণ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে বলে সরকার ঘোষণা করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীকে ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
যদিও ইলিশ লবণাক্ত জলের মাছ বা সামুদ্রিক মাছ, বেশিরভাগ সময় সে সাগরে থাকে কিন্তু বংশবিস্তারের জন্য দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নদীতে পাড়ি জমায়। বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশে নদীর সাধারণ দূরত্ব ৫০ কি.মি. থেকে ১০০ কিমি। ইলিশ প্রধানত বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা এবং গোদাবরী নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং প্রজননের জন্য এ এলাকাটিকে বেছে নেয়। ইলিশ মাছ সাগর থেকেও ধরা হয় কিন্তু সাগরের ইলিশ নদীর মাছের মতো সুস্বাদু হয় না। চাঁদপুর জেলার তিন নদীর মিলনস্থলে ইলিশ মাছ বেশি পাওয়া যায়। এজন্য চাঁদপুর জেলা ইলিশের জন্য বিখ্যাত এবং চাঁদপুরকে ইলিশের বাড়ি বলা হয়।
ইলিশ অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় মাছ। বঙ্গোপসাগরের ব-দ্বীপাঞ্চল, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর মোহনা থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ ধরা হয়। এটি সামুদ্রিক মাছ কিন্তু এই মাছ বড় নদীর মিঠা পানিতে ডিম দেয়। ডিম ফুটে গেলে ও বাচ্চা বড় হলে ইলিশ মাছ সাগরে ফিরে যায়। সাগরে ফিরে যাওয়ার পথে জেলেদের শিকারে এই মাছ ধরা পড়ে।
সম্প্রতি দীর্ঘ ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিগত বছরের ন্যায় এ বছরও বাজারে বেশ ভালো ও বড় আকারের প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের প্রাচুর্য্য দেখে মনে হয়েছে যেন, ইলিশের সেই সুদিন আবার ফিরে এসেছে। দেড়-দুই কেজির ওজনের পর্যন্ত ইলিশও এ বছর বাজারে দেখা গেছে, আগে যা ছিল স্বপ্নের মতো। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে লক্ষ্ণীপুরের কমলনগরের মেঘনা নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল ৩ কেজি ৬০০ গ্রাম ওজনের একটি ইলিশ- যা বিক্রি হয়েছিল ১৪,৫০০ টাকায়। এর আগে ২০১৬ সালে মেঘনা নদীতে সাড়ে তিন কেজির ইলিশ জালে উঠেছিল। এছাড়া, ২০১৮ সালে চাঁদপুর সদরে মেঘনা নদীতে ধরা পড়েছিল ৩ কেজি ২০০ গ্রামের ইলিশ। তবে এ বছর ইলিশের দাম তুলনামূলক বেশি, এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই ইলিশের স্বাদ নিতে পারেনি।
বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ শতাংশ এবং দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ প্রায় ১২ শতাংশ। দেশে গত ১৩ বছরে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। অর্থাৎ শেষ পাঁচ বছরে গড়ে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে আড়াই শতাংশের বেশি। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, প্রায় ৫ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
এই ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়ে অভিযান ও তদারকি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট ৩৮টি জেলার সব নদনদীতে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দিনে ও রাতে অভিযান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ এবং জাটকা ধরা নিষিদ্ধকালীন জাটকা ও ইলিশসমৃদ্ধ এলাকার জেলেদের জন্য বিগত বছরের ন্যায় এ বছরও পরিবার প্রতি ২৫ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যদি এসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তবে প্রতি বছরই ইলিশ মাছ এভাবেই সবার জন্য সহজলভ্য হবে।
এতে করে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে পরিচিত ইলিশের হারানো গৌরব 'মাছে-ভাতে বাঙালি' ফিরতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। এজন্য মাঠ প্রশাসনের সুষ্ঠু তদারকির পাশাপাশি কঠোর নজরদারি করা যেমন দরকার, ঠিক একই সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও জেলেদের সচেতন হওয়া একান্ত জরুরি। একটি মা ইলিশ প্রতি প্রজনন মৌসুমে একবারে সর্বোচ্চ ১ থেকে ২.৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ থেকে ২৩ লাখ পরিমাণ ডিম দেয় এবং যদি ৫০ শতাংশ ডিমও যথার্থভাবে বেড়ে উঠতে পারত, তাহলে বিভিন্ন নদী ও বঙ্গোপসাগরের অর্ধেকটা ইলিশের দখলে চলে যেত। এজন্য মা ইলিশ রক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক, দেশের অর্থনীতি ও আমিষের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক