শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

প্রেসিডেন্ট জিয়া :অনুপম দেশপ্রেমের এক মূর্ত প্রতীক

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজও প্রেসিডেন্ট জিয়া বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক- যার কর্মের বর্ম অবিশ্রান্ত আঘাত হেনে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্তদের ধমনি-শিরায় বহতা রক্তের স্রোতধারায় জাগায় নবজাগরণ; দেখায় সত্য-সুন্দর ও আলোর পথ।
এম. সাইফুর রহমান
  ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রেসিডেন্ট জিয়া :অনুপম দেশপ্রেমের এক মূর্ত প্রতীক

কোনো ভূখন্ডে বা কোনো জাতির জীবনে জ্ঞানী-গুণী, বীর বা নেতার জন্ম যুগে যুগে হয় না। আবার এসব মহান ব্যক্তিদের যথাযথভাবে কদর না করলে স্রষ্টা ওই জাতির মধ্যে তাদের মতো ব্যক্তিদের আর জন্ম দেন না। কথায় বলে, অনাদর-অবহেলায় গুণীরা ঝরে যায়। প্রাচীন গ্রিকরা সক্রেটিসের মতো মহান দার্শনিক ও সত্যপথের প্রদর্শককে বিষপানে আত্মহননে বাধ্য করে যে পাপ করেছিল আজও বোধ করি তার খেসারত গ্রিক জাতিকে দিতে হচ্ছে। শত শত বছরের ইতিহাসে গ্রিক জাতি এক সময় যে দোর্দন্ড প্রতাপ-প্রতিপত্তি আর সমৃদ্ধি নিয়ে পৃথিবীতে টিকে ছিল আজ সে গ্রিক জাতি কোথায়? শত শত বছর পার হয়ে গেলেও সক্রেটিস, ডায়জনিন, এরিস্টেটলের মতো জ্ঞানী-গুণীদেরও আর সে জাতির মধ্যে জন্ম হয় না। তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া বীর কেশরীরা আজ আর জন্ম নেন না। ইহুদি জাতি তাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সঙ্গে যে অন্যায় আচরণ করেছিল তার ফলে তারা হাজার হাজার বছর ধরে যাযাবরের মতো জীবনযাপন করছে। আজও তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়নি। কারণ জোর করে একটি দেশ তারা বানালেও নিশ্চিন্তে নিরুপদ্রবে তারা ঘুমোতে পারে না। এক অজানা আতঙ্ক আজও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। রোমানরা এক সময় পৃথিবীর সমৃদ্ধ জাতি ছিল। রোমান জাতিও তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান জুলিয়াস সিজারসহ অনেককেই হত্যা করেছিল। ফলে, তাদের মধ্যে আর কোনো মহাবীরের জন্ম নিতে দেখা যায় না। সেই প্রতাপশালী রোমান সাম্রাজ্যই আজ পৃথিবীতে নেই।

মানব জাতির ইতিহাসে এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, যে জাতি তার নিজের প্রতিভাধরদের বা জ্ঞানী-গুণীদের সম্মান করে না, কদর করে না- তারা আর তাদের মতো অন্য কাউকে ফিরে পায় না। বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিশ্ববরেণ্য হিসেবে আমরা কাজী নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্‌দীন, ফররুখ আহমেদকে পেয়েছি, আচর্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে পেয়েছি, অমর্ত্য সেনকে পেয়েছি এবং ড. ইউনূসকে পেয়েছি। শহীদ মীর নিসার আলী তীতু মীর, হাজী মোহাম্মদ শরীয়ত উলস্নাহ্‌, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, নেতাজী সুভাষ, সূর্যসেন, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমান এরা শৌর্যেবীর্যে বাঙালি জাতির গর্বের ধন, গৌরবের ধন। এদের জ্ঞান, গুণ, দক্ষতা ও কার্যক্রম আমাদের জাতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এরা বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে আমাদের সম্মানিত স্থান করে দিয়েছেন। এদের নিয়ে কোনো রাজনীতি চলে না, ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা চলে না। এরা ইতিহাসের কিংবদন্তীর মতো আমাদের মননে, বিশ্বাসে, চেতনায় সদা শ্রদ্ধেয়, সদাবরণীয়। তাই দল-মত ও পরশ্রীকাতরতা প্রদর্শনের ঊর্ধ্বে ওঠে সমগ্র জাতিকে তার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়। কেননা, একটি জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কেবল তাদেরই মর্তবার আসনে সমাসীন করে না, নিজেরাও যেমন শ্রদ্ধেয় হয়, তেমনি বিশ্বদরবারে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরিতাপের বিষয়, জাতি হিসেবে আমরা দুর্ভাগা। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশে যাদের ত্যাগ সীমাহীন; অপরিমেয় ছিল যাদের সাধনা, নিরুপম ছিল যাদের দেশপ্রেম আমরা তাদের যথার্থভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে পারিনি, লালন করতে পারিনি, তাদের প্রাপ্য সম্মান যথার্থভাবে প্রদর্শন করতে পারিনি। বরং ক্ষেত্র বিশেষ নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে তাদের অমূল্য অবদানকে অস্বীকার করণে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করছি না। কখনো কখনো জাতির এই বীর সন্তানদের অপমান-অপদস্ত করতেও লেশমাত্র শঙ্কাবোধ হচ্ছে না। এমনকি সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের গায়ে বিশ্বাসঘাতকতার কালিমালেপন করে দিতেও আমাদের কণ্ঠনালি কেঁপে উঠছে না। কী জঘন্য মনোবৃত্তি! অথচ দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই তারা জাতির ক্রান্তিকালে মৃতু্যবিভীষিকাকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অকাতরে; ঘুটঘুটে অন্ধকার সুড়ঙ্গে পথহারা জাতিকে দেখিয়েছেন পথের দিশা; রচনা করেছেন জাতীয় জীবনের সোনালি অধ্যায়। তারা রাজাদের রাজা, বীরদের বীর; তাদের হাত ধরেই হয়েছে জাতির জয়নব উত্থান। দেশপ্রেমের মহানমন্ত্রে উজ্জীবিত এমনই একজন কর্মবীর ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। দেশপ্রেম একটি জাতির জাতীয় গৌরব, এ কথা স্মরণ রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনার শীর্ষ পর্যায়ে থেকেও তিনি ছিলেন জনতার কাতারে। জনতার কাতারে থেকেই তিনি দরিদ্রতা, দুর্নীতি ও ব্যাধিমুক্ত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করেছিলেন। তাই তো তার প্রতিপক্ষ শত্রম্নরাও তার দুর্দান্ত সাহস, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, দেশ রক্ষার প্রতিজ্ঞা ও দেশপ্রেমের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা। এমন নেতারা সব সময়ই আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শত্রম্নতে পরিণত হন। তাদের চরম হয়রানির শিকার হতে হয়; এমনকি জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাকেও জীবন দিতে হয়েছিল। জীবন দিয়েই তিনি জীবিতদের মাঝে জীবনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাই তো শাহাদাতের এতগুলো বছর পরেও তিনি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে অনন্য।

দেশপ্রেমের অপার, অদৃশ্য, অস্পর্শ শক্তির টানে যুগে যুগে আলোকবর্তিকা হাতে পরাধীনতার ঘোর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যারা আশার বাণী শুনিয়েছেন, আত্মোৎসর্গ করেছেন তাদেরই একজন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় অভিযাত্রিক জিয়াউর রহমান। মৃতু্য বিভীষিকাকে ভয় না করে, বন্য-স্বাপদ-সঙ্কুল পথ পায়ে মাড়িয়ে নিঃসঙ্কোচ চিত্তে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশ রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরাজিত হলে মৃতু্য নিশ্চিত জেনেও তিনি হিমালয়ের মতো অটল-অবিচল থেকে পরাধীনতার শৃঙ্খলবেড়ি ভেঙে স্বাধীনতার মশাল জ্বেলে দেন। সেই সময়ের -প্রবল প্রতাপান্বিত পাকবাহিনীকে দোর্দন্ড পরাভূত করে মুক্তিযুদ্ধের অনলকুন্ড থেকে ছিনিয়ে আনেন লাল-সবুজের পতাকা- যা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক। যুদ্ধে অভূতপূর্ব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব 'বীর উত্তম'-এ ভূষিত করা হয়। যুদ্ধ শেষে তিনি পুনরায় ব্যারাকে ফিরে যান। একটি স্বাধীন, সুশৃঙ্খল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলায় আত্মনিবিষ্ট হন।

কথায় বলে, ইতিহাস যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে তার চলার পথ কেউ রোধ করতে পারে না। তাই তো ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এ এক রক্তাক্ত বিয়োগান্তক দৃশ্যপটের মধ্য দিয়ে জাতি যখন অন্ধকার সুড়ঙ্গে পথ হারায় তখন জাতীয় জীবনে নেমে আসতে থাকে একের পর এক সংকটময় পরিস্থিতি। এক সংকট কাটিয়ে না উঠতেই দেখা দেয় আরেক সংকট। এরই পরিক্রমায় বহুমাত্রিক সংকটের সন্ধিক্ষণে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপস্নবের মধ্য দিয়ে দেশ গড়ার দায়িত্ব আবার অর্পিত হয় জিয়াউর রহমানের স্কন্ধে। তিনি মৃতু্যকে পরোয়া না করে, মৃতু্যর নীড়ে মাথা নত না করে, কোনো অশুভ শক্তির সঙ্গে আঁতাত না করে এই গুরুভার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। রাজনৈতিক মঞ্চের সম্মুখ দরজা দিয়ে চলে আসেন পর্দার সামনে। রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বে জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক জ্ঞানে যেমন কোনো পন্ডিত ছিলেন না, তেমনি তিনি যেদিন ক্ষমতায় আসেন সেদিন কোনো দেশবরেণ্য বিজ্ঞ লোকও ছিলেন না। কিন্তু তার অদম্য দেশপ্রেম, জনগণের জন্য কাজ করার ইচ্ছা, সমস্যাকে ভয় না পেয়ে সমস্যার গভীরে দাঁড়িয়ে তা সমাধানের প্রাণপণ প্রয়াস এবং অক্লান্ত পরিশ্রম বহুস্বীকৃত রাজনীতিবিদ এবং নেতার চেয়ে তাকে বহুগুণ এগিয়ে নিয়ে গেছে; পরিণত করেছে একজন দার্শনিক রাজনীতিবিদ রূপে। তার অনুসৃত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও প্রবর্তিত বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বাধীনতার পাঁচ দশকের অধিককাল পরেও লেশমাত্র উপযোগিতা হারায়নি; বরং তা আরও বহুগণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শাহাদাতের এতগুলো বছর পরেও তিনি তার রাজনৈতিক দর্শনের বিরুদ্ধবাদীদের আক্রমণের শিকার। তার গৌরবান্বিত, স্বর্ণোজ্জ্বল জীবনে কালিমালেপনের মধ্য দিয়ে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার এমন কোনো হীন-জঘন্যতম অস্ত্র নেই- যা তার বিরুদ্ধবাদীরা ব্যবহার করেনি। তারপরও তারা সফল হয়নি। কেননা, তিনি কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছেন তার মানবীয় গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে; দেশপ্রেমের আলোকবর্তিকার আলো ছড়িয়ে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজও প্রেসিডেন্ট জিয়া বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক- যার কর্মের বর্ম অবিশ্রান্ত আঘাত হেনে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্তদের ধমনি-শিরায় বহতা রক্তের স্রোতধারায় জাগায় নবজাগরণ; দেখায় সত্য-সুন্দর ও আলোর পথ।

লেখক : সাহিত্যিক, গবেষক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে