দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে হবে
প্রকাশ | ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মো. জাহিদ হাসান
একটি দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সে দেশকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। যে দেশে দারিদ্র্যের হার যত কম, সে দেশ তত উন্নত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার এখন ১৮.৭ শতাংশ। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৮ অনুযায়ী ৬ বছর আগে, যা ছিল ২৪.৩ শতাংশ। এই জরিপ অনুযায়ী দেশে অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ১২.৯ শতাংশ। ২০২২ সালের জরিপে যা কমে হয়েছে ৫.৬ শতাংশ। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৪.২ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাসের এই অভাবনীয় সাফল্য দেখে বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশের বড় সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ শতাংশ দারিদ্র্যের হার কমছে। জাতি সংঘের হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৪ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কিন্তু উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে দারিদ্র্যবিমোচনের কিছু প্রধান অন্তরায় দূরীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দারিদ্র্যের একটি মূল কারণ হলো অতিমাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি বেকারত্ব বৃদ্ধি করে। আর বেকারত্বের ফলে দেশের মাথাপিছু আয় কমে যায়, বেড়ে যায় দারিদ্র্য। দেশের প্রতিটি নাগরিক যখন নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি উপার্জন করতে পারবে তখন দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাবে এবং অবিলম্বে দারিদ্র্য থেকে দেশ মুক্তি পাবে। দেশের নাগরিকরা দক্ষ ও কর্মঠ হলে জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয়, বরং দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু আমাদের জনবহুল বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাবে হাজার হাজার যুবক ঘরে বসে বেকার জীবন পার করছে। এর ফলে অনেক বেকার যুবকদের পরিবারও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কেননা উচ্চশিক্ষা শেষ করে পরিবারের হাল ধরার জন্য যুবকেরাই একমাত্র অবলম্বন। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য যুবকদের স্বাবলম্বী হতে হবে, উদ্যোক্তা হতে হবে। সরকারি চাকরির আশায় বসে না থেকে এখন দেশের অনেক যুবক আউটসোর্সিং করে মাসে লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে অনেক যুবক এখন বিভিন্ন ব্যবসা এবং আধুনিক কৃষিতে যুক্ত হয়ে সাফল্যের মুখ দেখছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদেশি ও নতুন জাতের ফসল চাষ করে সফলতা পাচ্ছে আধুনিক কৃষি উদ্যোক্তারা। কালের পরিক্রমায় বিলুপ্তির পথে এমন দেশীয় নানা শিল্পজাত দ্রব্য ও পণ্য আছে, যা প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ রয়েছে। জনবলের অভাবে প্রতিবছর দেশের অনেক জমি অনাবাদি থাকে। অন্যদিকে কাজের অভাবে অনাহারে দিন কাটায় অনেক শ্রমজীবী মানুষ। নদীমাতৃক এ দেশে আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে মাছ চাষ যে কাউকে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিতে পারে। ঋতুবৈচিত্র্যের এ দেশে একেক অঞ্চলে একেক সময় একেক ধরনের ফসল উৎপাদন হয়। বেকার বসে না থেকে দেশের নানা প্রান্তে নিজ অঞ্চলের বিখ্যাত ফসলের ব্যবসা শুরু করে যে কেউ ভালো অর্থ আয় করতে পারে। ব্যবসার বিভিন্ন ক্ষেত্র রয়েছে। ব্যবসায় ক্ষতির ব্যাপার থাকলেও ঠিক পরিকল্পনা নিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী শুরু করলে যে কোনো ব্যবসায় সাফল্য আসবে। এছাড়া বর্তমানে তরুণ উদ্যোক্তারা বিভিন্ন খামার প্রকল্প শুরু করে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে, এর মাধ্যমে আবার অনেকের কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হচ্ছে। সাফল্যের জন্য ধৈর্যের সঙ্গে পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু অলস জাতি হিসেবে বাঙালিদের একটি কুখ্যাতি রয়েছে। আমাদের এই অলস স্বভাব এবং কাজকে ছোট বড় করে দেখার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। শিক্ষিত হলেই সরকারি চাকরি করতে হবে, এমন চিন্তা বাদ দিতে হবে। দারিদ্র্যের কাঠিন্য এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে যে কোনো ভালো কাজের মর্যাদা দিতে হবে এবং কাজ করতে হবে।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির আরও একটি বড় কারণ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি একটি দেশের অর্থনীতিতে বড় আঘাত করে। এটি রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংস করে দেয়। ফলে দেশের মানুষের একটা বৃহৎ অংশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যায়। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচু্যতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইডিএমসি)-র হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ৪৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছে। একই সংস্থায় ২০১৯ সালের অর্ধবার্ষিকী প্রতিবেদনের হিসাব মতে, বাংলাদেশের ২৩টি জেলা থেকে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে, এর বেশিরভাগই ঘটেছে বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে, যেমন- ভোলা, খুলনা, পটুয়াখালী। বাস্তুচু্যতির ঘটনার প্রধান কারণ বন্যা ও নদী ভাঙন। দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে তীব্র খড়ার কারণেও অনেক মানুষ বাস্তুহারা হয়। এছাড়া ভূমিকম্প ও ভূমিধসের কারণেও বাস্তুচু্যতির ঘটনা ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্ব হারিয়ে এসব বাস্তুচু্যত মানুষকে অন্যত্র গিয়ে দারিদ্র্যের কুঠারাঘাত সহ্য করে প্রতিনিয়ত মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। ডিসপেস্নসমেন্ট সলু্যশানস্-এর এক গবেষণায় ধারণা করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নানা দুর্যোগের আরও অবনতি ঘটতে পারে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৩ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো পরিবেশ দূষণ। আর বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে ঘটছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দূষণের ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬৫০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়, যা মোট জিডিপির সাড়ে তিন শতাংশ। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং নানা দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন থেকেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। তা না হলে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতির ফলে বাংলাদেশ কখনোই দারিদ্র্য থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাবে না।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য কারণ হলো সরকারি নানা সেবায় বৈষম্য। দেশের দরিদ্র ও অসহায় জনগণের জন্যই মূলত সরকারি আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু ক্ষমতাধারী কিছু অসাধু ব্যক্তির হস্তক্ষেপে অসহায় মানুষেরা সরকারি নানা সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। দরিদ্র জনগণ সরকারি সহায়তাটুকুও যদি হারায় তাহলে তারা একটু সচ্ছল হওয়ার পরিবর্তে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যাবে। এছাড়া সরকারি কাজে নানা দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়, যা পরোক্ষভাবে দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের একটি বড় অন্তরায়। দারিদ্র্যের কারণে দেশের অসংখ্য মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পুষ্টিহীনতার ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। পুষ্টিহীনতা মানবদেহে নানা রোগ সৃষ্টি করে এবং অনেক মানুষকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে তোলে। যার ফলে অনেকাংশে দেশের জনশক্তি কমে যায় এবং দারিদ্র্য বাড়ে। এছাড়া নানা কারণে এখনো সুচিকিৎসা পায় না দেশের অনেক মানুষ। তাই পুষ্টি চাহিদা পূরণে এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে আমাদের দেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সব নাগরিকদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্বন্ধে যথাযথ ধারণা তৈরির পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে এর ব্যবহার শুরু করতে হবে। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার অন্যতম হাতিয়ার শিক্ষা। কথায় আছে যে শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। তাই সুনাগরিক তৈরির জন্য, জাতির উন্নয়নের জন্য এবং দারিদ্যকে দূর করার জন্য সবাইকে সুশিক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়া দারিদ্র্য নিরসনে একে অন্যের প্রতি সহযোগিতা খুবই জরুরি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিত্তশালী বা সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের করণীয় হবে বৈষম্য না করে সমাজের দরিদ্র ও অসহায় লোকদের সাহায্য করা। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ নানা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা অল্প বয়সেই লেখাপড়া সুযোগ হারিয়ে শিশুশ্রমের শিকার হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে নানা সামাজিক অপরাধ, চিকিৎসার অভাবে এবং পুষ্টিহীনতায় ভুগে অকালেই ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ, বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রথা বাড়ছেই, বাড়ছে নানা পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা। দারিদ্র্যের কারণে যেমন ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়, তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষতিও হয়। দারিদ্র্যের কারণে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, মাথাপিছু আয় কমে যায়, কমে যায় জিডিপির হার, বাড়তে থাকে বৈদেশিক ঋণ, দেশের নানা চাহিদা মেটাতে গিয়ে আর নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। মোটকথা দারিদ্র্য একটি দেশের সার্বিক উন্নতির পথে বড় বাধা। এই বাধা দূর করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কার্যকরী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে, সেই সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সব জনগণকে সচেষ্টভাবে কাজ করে যেতে হবে। দারিদ্র্য মুক্তি-ই হবে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রধান লক্ষ্য অর্জন।
মো. জাহিদ হাসান
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া