বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও সরকার পতনের ডামাডোলের মাসে ব্যাংকে গ্রাহকরা টাকা রেখেছেন কম। এক মাসের ব্যবধানে আগস্টে আমানত কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালের একই সময়ে অর্থাৎ জুলাই থেকে পরের মাস আগস্টে আমানত বেড়েছিল ২৩ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ব্যাংক খাতে আমানতের হালনাগাদ তথ্য বলছে, আগস্ট শেষে ৬১টি ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। জুলাইয়ে যা ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ১০ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, শতকরা হিসাবে কমেছে শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর অর্থ ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে। জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে টাকা ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। আগস্টে তা ১ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা।
এটা সত্য, ক্ষমতার পালাবদলের পর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো বিপাকে পড়ে। বিশেষ করে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক গ্রম্নপ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয়। সরকার পতনের পর এসব ব্যাংক নিয়ে গুজব ও গুঞ্জনে ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখা বন্ধ করে দেয় গ্রাহকরা। উল্টো অনেকে এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে থাকেন। এর প্রভাব পড়েছে আমানত সংগ্রহে। ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ওপর এ সময়ে মূলত ইসলামী ধারার ব্যাংক এবং এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকে গ্রাহকের টাকা জমা না রাখার প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, 'আগস্টে সরকার পতনের পর ব্যাংকিং খাতের আমানতের ওপর প্রভাব পড়ে। সেসময় অনেক ইসলামী ধারার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ধারণা করে গ্রাহকরা টাকা উত্তোলন করেছেন। তাতে আমানত অনেক কমে যায়। তবে বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা বাড়ছে। ব্যাংকে আমানত ফিরছে।' ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ওপর অনেকদিন ধরেই এক রকম অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। সরকার পতনের পর জনমনে ভীতি তৈরি হয়েছিল এসব ব্যাংকের টাকা পাওয়া যাবে কিনা। সে জন্যই গ্রাহকরা টাকা উত্তোলন করেছে। নানা অনিয়মের মাধ্যমে এসব ব্যাংকের অনেক বড় রকম ক্ষতি করা হয়েছে।
ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিএআর) অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে- ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনের এসব দেশের সিএআর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা সিএআরের এই চিত্রের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক পরিস্থিতি। একটি ব্যাংকের সিএআর যত বেশি হয়, সেই ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য তত ভালো বলে মনে করা হয়। এটা ব্যাংক খাত সংক্রান্ত সাধারণ অর্থনীতির হিসাব। সম্প্রতি দেশের ১০টি ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগে দেউলিয়া হওয়ার পথে চলে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিবাচক উদ্যোগে তা রক্ষা পেয়েছে। দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে সে অনুপাতে মূলধন বাড়ছে না। আবার ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদও বাড়ছে। অনেক ব্যাংক নানা অভ্যন্তরীণ কারণে প্রকৃত আর্থিক চিত্র প্রকাশও করছে না। ফলে, দেশের ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী না হয়ে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক।
আমরা মনে করি, দেশের ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়াতে হলে খেলাপি ঋণ যেমন কমাতে হবে, একইভাবে ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে হবে। সে জন্য জনআস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে- যাতে মানুষ ব্যাংকবিমুখ না হয়। তারা যাতে ব্যাংকে লগ্নি করে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় বাংককে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।