বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া অশুভ
গণতান্ত্রিক, মেধাভিত্তিক আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বাংলাদেশ গঠন করতে হলে দেশের তরুণ ও ছাত্রসমাজকে সুষ্ঠু ধারার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে মননশীল, মেধাভিত্তিক নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। কারণ এই শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণরাই অনাগত দিনে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিসহ দেশের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মো. আতিকুর রহমান
বিগত ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের ফলে দেশের বুক থেকে দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরশাসনের জগদ্দল পাথর নেমে যাওয়ায় দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে, মুক্ত হয়েছে দেশের আপামর জনসাধারণ। এর ফলে, মুক্তভাবে দেশের মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারছে। দীর্ঘদিন মানুষের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা' ছিল না, ছিল না মত প্রকাশের স্বাধীনতা। অত্যাচার-নির্যাতনের খড়গ্ চাপিয়ে যে কোনো পন্থায় ভিন্নমত দমনে যেভাবে জঘন্যতম স্টিমরোলার চালানো হয়েছে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে তা নজিরবিহীন, একথা বলাইবাহুল্য। তাই ৫ আগস্টের গণ-অভু্যত্থানের পর সব শ্রেণিপেশার মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করবে আপামর জনসাধারণ।
মানুষের মতপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ও পস্ন্যাটফর্ম হচ্ছে নিজ নিজ আদর্শের রাজনৈতিক সংগঠন। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ১৯৪৮-এর ধারা ১৮ ও ১৯ দ্বারা যে কোনো ভূখন্ডের যে কোনো নাগরিকের ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণ করে শপথ নিয়েছে এবং অদ্যাবধি বিদ্যমান সংবিধানকেই বহাল রেখেছে। যদিও দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে একটি জনমুখী ও জনহিতকর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে 'সংবিধান সংস্কার কমিশন' গঠন করা হয়েছে। তর্কের খাতিরে যদিও ধরেও নেই যে, নতুন সংবিধান দ্বারা বিদ্যমান সংবিধানের সবকিছুর আমুল পরিবর্তন করা হবে, তথাপিও নতুন সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই দেশের সব নাগরিক তাদের অধিকার ভোগ করবে। বিদ্যমান সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ যে কোনো বিবেচনায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯ অনুচ্ছেদ দ্বারা শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়া, জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার, রাজনৈতিক সংগঠন করার, রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার এবং চিন্তা ও ভাব প্রকাশের তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে- যা সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ১৯৪৮-এর ধারা ১৮ ও ১৯-এর সমতুল্য। সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯ অনুচ্ছেদ দ্বারা নিশ্চিতকৃত অধিকার শুধু জরুরি অবস্থার বিধানাবলি সাপেক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকে।
৫ আগস্ট ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যে সুশৃঙ্খল আবহ বইছে, কোনো এক অদৃশ্যশক্তির প্রভাবে সেই সুবাতাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করার পাঁয়তারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের সর্বত্র রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলমান থাকলেও সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে, মব জাস্টিসের ন্যায় সময়ের ট্রেন্ড বা কালের প্রবণতা অনুসরণ করে অহেতুক কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি স্থগিত করা হয়েছে, কোথাও কোথাও অতি উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক ছাত্র রাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাহলে এ প্রশ্ন রাখা কি অবান্তর হবে যে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর জনমনে স্বাধীনভাবে মত ও দ্বিমত প্রকাশের যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বাইরে রাখা হয়েছে? নাকি দেশের সর্বত্র স্বাভাবিক পরিবেশ থাকলেও শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে জরুরি অবস্থা চলছে- যার কারণে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অধিকার স্থগিত করা হয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে দেশজুড়ে যখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলে, তখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নেই কেন? যে সময়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, গঠন করা হয়েছে ৬টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কার কমিশন, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে বরং রাজনীতি স্থগিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে- যা বিরাজনীতিকরণেরই ভিন্ন রূপ।
মনে রাখতে হবে, বর্তমান সমাজের নাগরিকদের চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা কোনো নির্দিষ্ট দেশের পরিসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং গণযোগাযোগ মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এ সমাজের নাগরিকদের চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত। এ কারণেই বর্তমান শিক্ষিত সমাজের নাগরিকদের বিশ্বনাগরিক বলে মনে করা হয়। ৩৬ জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে যে ফ্যাসিবাদ মুক্ত গণতান্ত্রিক, মেধাভিত্তিক, আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের বীজবপন করা হয়েছে, সব মতের মানুষের ন্যায়সঙ্গত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লাভের যে প্রত্যাশা সৃষ্টি করা হয়েছে, যে কোনো প্রকার বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া সে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণের পথে নিঃসন্দেহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
গণতান্ত্রিক, মেধাভিত্তিক আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বাংলাদেশ গঠন করতে হলে দেশের তরুণ ও ছাত্রসমাজকে সুষ্ঠু ধারার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে মননশীল, মেধাভিত্তিক নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। কারণ এই শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণরাই অনাগত দিনে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিসহ দেশের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তাই যে কোনো প্রকার বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা প্রদর্শন আবশ্যক। সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের দিকটাও আবশ্যিকভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।
মো. আতিকুর রহমান : কলাম লেখক