পুঁজিবাদ ও গণ-অভু্যত্থানের আকাঙ্ক্ষা

দেশ স্বাধীনের পর যতগুলো দল ক্ষমতায় এসেছে তা কতটুকু গণমানুষের চিন্তা করেছে, কতখানি সাম্যের সমাজ বিনির্মাণে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে? এসব প্রশ্নোত্তর একজন সচেতন নাগরিকের অজানা নয় নিশ্চয়ই। একটা রাষ্ট্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে পাঠ্যবইগুলোকে সাম্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা এবং রাজনৈতিকভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক, শোষণহীন, বৈষম্যহীন ও প্রগতি ধারার নেতৃত্বের বিকল্প নেই।

প্রকাশ | ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

জাফর হোসেন জাকির
গণ-অভু্যত্থান হয় গণ-মানুষের ভেতরে চাপাপড়া দুর্দশা, নির্মমতা, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও গণহত্যার মতো জঘন্যতম মানবতাবিরোধী বৈষম্যমূলক শাসকগোষ্ঠীর অপরাধ এবং ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কারণে। যতবার একটা রাষ্ট্রে সরকার ব্যবস্থা জনবিচ্ছিন্ন ও স্বৈরশাসক হয়ে উঠবে, ততবার ওই রাষ্ট্রে গণ-অভু্যত্থান নতুনরূপে দেখা দেবে। বাংলাদেশ জুলাই '২৪ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভু্যত্থান তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রচলিত একটা বাক্য ছিল কিংবা আছে, 'কথা বলতে টাকা লাগে না'। কিংবা কোনো কিছুর মূল্য তুলার্থে বলা হতো, 'পানির দামের মতো সস্তা'। হরহামেশাই বাক্যগুলো আগে উচ্চারণ করা গেলেও বর্তমানে উচ্চারণ করতে গিয়ে চিন্তার কারণ ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়েও অনেকেই। যদি প্রশ্ন করে বসেন কেন? জবাব দিতে গিয়ে আবারও প্রশ্নের জন্ম নেয় যে, টাকা ছাড়া কী সব সময় সব জায়গায় কথা বলা যায়? টাকার বিনিময় (ঘুষ) ছাড়া কী কোনো দপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ফাইলের ধূলিকণা পরিষ্কার হয়? টাকা ছাড়া কী মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়া যায়? বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তিপ্পান্ন বছরে এসেও কী অর্থনীতির বৈষম্য দূর হয়েছে? অঙ্কের দিক থেকে যার টাকা (পুঁজি) বেশি এবং যার কম- এই দুই ব্যক্তি কী রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমান ও সমমানের সুযোগ-সুবিধা পায়? জুলাই '২৪ ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থান যে বৈষম্য শব্দকে কেন্দ্র করে হয়েছে অভু্যত্থান পরবর্তী দেশে কী সব জায়গা থেকে বৈষম্য দূর হবে? বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উপজেলার মধ্য রতনপুর এলাকার কাওসার হোসেন খান ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করত নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে। জুলাই '২৪ ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের পর ৩০ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় কাওসারের মৃতু্য হয়েছে। খেয়াল করে দেখুন, সংঘর্ষ হয়েছে দুই গ্রম্নপের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যে ছেলে কিংবা মেয়েরা চাকরিতে প্রবেশ করেন অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে তারা কেমন পরিবারের সন্তান? আর যারা পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তাদেরও অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? নিজ এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখলেই এসব প্রশ্নের উত্তর মিলে। একজন শ্রমিক কেমন করে তার জীবন পার করবেন, কেমন করে বাবা-মায়ের মুখে ভাত তুলে দেবেন, কেমন করে তার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাবেন- এসব প্রশ্নের সমাধান খানিকটা হলেও কারখানায় পাবেন বলে সে শ্রমিক খাতায় নাম লেখায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কী এসব প্রশ্নের সমাধানের জন্য চাকরিতে যুক্ত হয় না? নিশ্চয়ই। দ্বন্দ্ব লাগল একই শ্রেণির মধ্যে। কেননা, তারা একই উদ্দেশ্যে (অর্থনৈতিক মুক্তি) অর্থাৎ নিজের এবং পরিবারের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। তাহলে দ্বন্দ্ব লাগল কেন? শ্রমিকরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে পুঁজি উপার্জনের ধারা টিকিয়ে রাখা এবং পেটে ভাত দেওয়ার জন্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরাও তাই। আর দ্বন্দ্ব লাগিয়েছে পুঁজিপতিরা। এটাই পুঁজিবাদের চরিত্র। জুলাই '২৪ ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের শুরুর দিকে শুধু ছাত্ররাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধান শহরগুলোতে কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলন করে। কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালে আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুন। পহেলা জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'র ব্যানারে সংগঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাস ও এর আশপাশে মিছিল-সমাবেশ করে। শিক্ষার্থীরা বাংলা বস্নকেড, গায়েবানা জানাজা, কমপিস্নট শাটডাউন, জাস্টিসের জন্য মার্চ, দ্রোহ যাত্রা ও মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলন চালানোর সময় সারাদেশের মানুষ আন্দোলনে যুক্ত হয় ফ্যাসিবাদী কায়দা থেকে মুক্তির জন্য। আন্দোলন গণ-অভু্যত্থানে রূপ নেয়। সারাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ যুক্ত হয় জুলাই '২৪ অভু্যত্থানে। এইচআরএসএস-এর প্রতিবেদনে তাকালে তা স্পষ্ট হওয়া যায়। ২০২৪ সালের গণ-অভু্যত্থানে সংঘটিত হত্যাকান্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত এক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে ২৯৩ জনের পেশা বিশ্লেষণ করে বলা হয়, এর মধ্যে ১৪৪ জন শিক্ষার্থী, ৫৭ জন শ্রমজীবী, ৫১ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ৫ জন সাংবাদিক এবং ৩৫ জন অন্য পেশার মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ৮১৯ জনের মৃতু্য হয়েছে। এ সময় সারাদেশে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। অধিকাংশই গুলিতে আহত হন। শিশু থেকে বৃদ্ধ এই আন্দোলনে যুক্ত হলো কেন? কারণ প্রত্যেকের চাওয়া ছিল সমাজ তথা দেশ থেকে শুধু চাকরির বৈষম্য নয়, সব বৈষম্য দূর হোক। দেশ স্বাধীনের ৫৩ বছর পার করছি অথচ আসল মুক্তিযোদ্ধা আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাষ্ট্র এখনো জাবর কেটে মুখে ফেনা তুলছে, শিক্ষা খাতে নিম্নবাজেটের বৈষম্য দূর করে উন্নত বিজ্ঞানভিত্তিক একই ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে পারছে না, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে না পাঠিয়ে দেশে চিকিৎসা দিতে পারছে না, কৃষকের উৎপাদন খরচ আর বিক্রয়মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্যতা রাখতে পারছে না, শ্রমিকের শ্রম চুরি থেকে বেড়িয়ে শ্রমের ন্যায্যমূল্য দিতে পারছে না, মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য-মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিত করতে পারছে না। কত বছর আর কত শাসন আমল পার করলে রাষ্ট্র হবে গণমানুষের, সাম্যের ও সুশাসনের? দেশ স্বাধীনের পর যতগুলো দল ক্ষমতায় এসেছে তা কতটুকু গণমানুষের চিন্তা করেছে, কতখানি সাম্যের সমাজ বিনির্মাণে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে? এসব প্রশ্নোত্তর একজন সচেতন নাগরিকের অজানা নয় নিশ্চয়ই। একটা রাষ্ট্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে পাঠ্যবইগুলোকে সাম্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা এবং রাজনৈতিকভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক, শোষণহীন, বৈষম্যহীন ও প্রগতি ধারার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। জুলাই '২৪ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভু্যত্থানের আকাঙ্ক্ষা কী? ধর্মের ভিত্তিতে দেশের মানুষকে ভাগ করা? মুসলমানদের ধর্মীয় উৎস কোনো প্রশাসনিক প্রোটোকল ছাড়াই পালন করা আর হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের ধর্মীয় উৎসবে ব্যারিকেট হিসেবে চৌকিদার, আনসার, বিজিবি, পুলিশ আর সেনাবাহিনী রাখা? পুঁজিপতিদের সন্তান মাসে লাখ টাকা খরচ করে নামিদামি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা আর খাদ্যের জোগানদাতা একজন পা-ফাটা দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষকের সন্তানরা গ্রামের অবহেলিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করা? পুঁজিবাদীরা তাদের কারখানায় প্রতিনিয়ত শ্রম চুরি করে আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়া আর শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত পানিরূপে ঘাম হয়ে ঝরে শরীর হাড্ডিসার করা? দ্রব্যমূলের লাগামহীন ঘোড়ার পিটে চড়তে ৮ ঘণ্টার বদলে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা শ্রম বিক্রি করা? নাগরিক তার ভোট দিতে গিয়ে ভয়ে কিংবা চাপে অযোগ্য দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে ভোট দিতে বাধ্য করা অথবা তার ভোট অন্য কেউ দিয়েছে এই খবর শুনে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে বিচার কাকে দেব- এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে বাড়িতে ফেরা? নিশ্চয়ই না। দেশ থেকে সব বৈষম্য, দুর্নীতি, ভুলনীতি, অন্যায়সহ অপরাধমূলক কর্মকান্ড দূর করাই হলো জুলাই '২৪ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভু্যত্থানের আকাঙ্ক্ষা। এই কলাম লেখার সময় পাশের রুমে কাজ করা কুলি-শ্রমিক একে অপরকে জিজ্ঞেস করছে, 'হারে ভাই, হাসিনা থাকার সময় যে জিনিসপত্রের দাম ছিল ছাত্ররা তাক পিটি দিয়া কোটে তা জিনিসপত্রের দাম কমাইল? হামার সাধারণ মানষিলার দিক কাহো তাকাবে না?' কেউ কেউ আবার চায়ের দোকানে বসে চিন্তা করে বলছেন, নির্বাচনের পর আবার কোনো ফ্যাসিবাদ কিংবা উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় এসে দেশকে অস্থিতিশীল করে কিনা! কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি মৌন সমর্থন থাকলেও রংপুরের বেরোবি'র ছাত্র আবু সাঈদ হত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ১৬ জুলাই নীলফামারী জেলার ডাঙ্গারহাটে গুটিকয়েক প্রগতিশীল মানুষ আন্দোলন শুরু করে। দিন পার হতেই আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়। প্রত্যেকের চাওয়া ছিল সমাজ থেকে সব বৈষম্য দূর হোক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে কোটিপতি ছিলেন ৯৮ জন। সর্বশেষ ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে ওয়েলথ-এক্স'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের মালিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। দেশ স্বাধীনের পর যত যুগ অতিক্রম করছে তত কোটিপতিদের সংখ্যা পিরামিড আকারে বাড়তে থাকে। ফলে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। অন্যদিকে, গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে। কেউ খাবার না পেয়ে অপুষ্টিতে ভোগে আবার কেউ অতিরিক্ত খাবার পেয়ে রোগ নিয়ে দেশ-বিদেশে চিকিৎসার জন্য ঘুরে। পুঁজিবাদীদের পুঁজি বৃদ্ধি আর অর্থের মাপকাঠিতে গরিবেরা সবকিছু হারিয়ে প্রলেতারিয়েত (সর্বহারা) হতেই থাকে তবে জুলাই '২৪ গণ-অভু্যত্থানে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা গতানুগতিকভাবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। জাফর হোসেন জাকির : কলাম লেখক