শক্তিশালী কাউন্টার ন্যারেটিভ গড়ে তোলা জরুরি
ফ্যাসিস্ট ন্যারেটিভ সাধারণত জাতীয়, ধর্মীয় বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। এই চিন্তাধারার বিরুদ্ধে একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করতে হলে প্রথমেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের মতো মৌলিক ধারণাগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
ফ্যাসিস্ট ন্যারেটিভের মূল বৈশিষ্ট্য হলো একক শাসন ব্যবস্থা, বিরোধী মতের দমন এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে একমুখী আদর্শ প্রতিষ্ঠা। এমন পরিস্থিতিতে ভিন্নমত বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনো স্থান থাকে না। একটি ফ্যাসিস্ট সরকার বা দল সমাজের ভয়, আতঙ্ক এবং বিভাজনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি সংহত করতে চায়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত, সচেতন ও 'কাউন্টার ন্যারেটিভ'।
নির্মাণের এই প্রক্রিয়াটি সহজ নয় এবং এটি আপনাআপনি ঘটে না। বরং এটি সচেতন প্রচেষ্টা, নেতৃত্ব এবং গণমানুষের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। কীভাবে একটি গণ-আন্দোলন বা গণ-অভু্যত্থানের ন্যারেটিভ গড়ে তোলা যায় এবং ফ্যাসিস্ট প্রচারণার মোকাবিলা করা সম্ভব, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা নিচে দেওয়া হলো :
১. গণতান্ত্রিক ধারণা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা
ফ্যাসিস্ট ন্যারেটিভ সাধারণত জাতীয়, ধর্মীয় বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। এই চিন্তাধারার বিরুদ্ধে একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করতে হলে প্রথমেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের মতো মৌলিক ধারণাগুলোকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এগুলোই সাধারণ মানুষের অধিকারের মূল ভিত্তি। তাই জনগণের মাঝে এই ধারণাগুলোকে পুনঃস্থাপন করতে হবে।
২. ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন
ফ্যাসিস্টরা প্রায়ই ইতিহাসকে নিজেদের সুবিধামতো বিকৃত করে উপস্থাপন করে। কাউন্টার ন্যারেটিভে ইতিহাসের সত্যি ঘটনাগুলোকে তুলে ধরা জরুরি। জাতীয় সংগ্রাম ও জনগণের লড়াইয়ের সঠিক চিত্র, যেমন ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম বা ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে জনগণকে জানাতে হবে যে অতীতেও জনগণ তাদের অধিকার আদায়ে সফল হয়েছে।
৩. গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ
ফ্যাসিস্টরা সাধারণত গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। এর মোকাবিলায় 'বিকল্প গণমাধ্যম' ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে। নির্ভুল তথ্য প্রচার এবং মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজের মানবিক ও গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার করা যেতে পারে।
৪. জনগণের সঙ্গে আবেগগত সংযোগ তৈরি করা
ফ্যাসিস্ট ন্যারেটিভ ভয়, আতঙ্ক এবং ঘৃণার ওপর ভিত্তি করে মানুষকে বিভক্ত করে। কাউন্টার ন্যারেটিভের বিপরীতে ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং সমানাধিকারের বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। জনগণের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা এবং ইচ্ছার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
৫. গণ-আন্দোলনের উদাহরণ তুলে ধরা
একটি শক্তিশালী গণ-অভু্যত্থানের ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে হলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। যেমন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বা ভাষা আন্দোলন যেভাবে জনগণের ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে সফল হয়েছিল, সেগুলোর উদাহরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। জনগণকে বোঝাতে হবে যে, ঐক্যবদ্ধ হলে তারা ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
৬. সচেতন নেতৃত্ব ও সংগঠনের বিকাশ
কাউন্টার ন্যারেটিভ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ। একটি সচেতন আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করতে হবে এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে আন্দোলনের পথ দেখাতে হবে। জনগণকে শুধু আদর্শ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না, তাদের সংগঠিত করার জন্য কার্যকর নেতৃত্বের প্রয়োজন।
৭. তথ্য ও প্রচার যুদ্ধ
ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রায়ই মিথ্যা প্রচারণা ও বিভ্রান্তি ব্যবহার করে নিজেদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে তথ্যসচেতনতা বাড়াতে হবে। সত্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের প্রচার করতে হবে, যাতে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ফ্যাসিস্ট ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে এটি বুঝতে হবে যে এটি শুধু একটি আদর্শিক লড়াই নয় বরং একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইও। সচেতন উদ্যোগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ন্যারেটিভ গড়ে তোলা সম্ভব। জনগণের সচেতনতা, নেতৃত্বের সঠিক প্রয়োগ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম : কলামিস্ট, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ