কৃষিই আমাদের প্রধান ভরসা

আমাদের দেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই আমাদের খাদ্যের অন্যতম জোগানদাতা। তাই কৃষিকে এগিয়ে নিতে কৃষি উপকরণের পাশাপাশি আধুনিকযন্ত্রের উদ্ভাবনী প্রয়াসে অনেক গুরুত্বারোপ করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে আমাদের কৃষি কাজ করা সহজসাধ্য হবে বলে মনে হয় না। প্রাকৃতিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ও ঘূর্ণির তান্ডবে ভয়াবহ প্রতিকূলতার মধ্যে কৃষিকে এগিয়ে নিতে হবে।

প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

অলিউর রহমান ফিরোজ
এবারের কয়েক দফার বন্যার তোড়ে কৃষকের আমন ধানের জমি তলিয়ে গিয়ে তাদের দিশেহারা করে তুলেছে। তবে দেশের কিছু কিছু এলাকায় আগাম জাতের উচ্চফলনশীল আমন চাষ করায় তারা লাভবান হতে পেরেছেন। আশ্বিন এবং কার্তিক মাসে এমনিতেই অনেক কৃষক বেকার হয়ে পড়েন। তাদের হাতে তেমন কোনো কাজ থাকে না। অভাব-অনটনের জন্য মহাজনী ঋণের জালে এ সময় তাদের জীবন কাটাতে হয়। কিন্তু আগাম জাতের আমন তাদের সেই দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে পেরেছে। আমাদের দেশ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের রোষানলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাতে করে কৃষিসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন ঘটে চলেছে। আবার নিয়মিত আমন চাষের জন্য যখন পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের দরকার তা অনেক এলাকার হয়নি। তাতেই ধানে চিটা দেখা দিয়েছে। সে এলাকার কৃষকরা আমনে বড় ধরনেও মার খেয়েছেন। নানা জটিলতায় ঘেরা আমাদের কৃষকরা তাদের স্বপ্ন বুননে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছেন। বারবার ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার তান্ডবে পড়ে তারা মূলত এখন অসহায় বোধ করছেন। ঘুরে দাঁড়াতে যেয়ে হোঁচট খাচ্ছেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কৃষিতে টিকে থাকাটাই যেন কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করেই আগামীতে তাদের টিকে থাকতে হবে। তবে তার রূপরেখা কি হবে। কৃষি মৌসুম আগে শুরু করা যায় কিনা। গেলেও ধানের জাত কি হবে তা নিয়ে এখন কৃষি বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট ভাবার সময় এসেছে। নইলে বারবার কৃষি ক্ষতির মুখে পড়ে তারা এখন বিধ্বস্ত। যেমন এখন কৃষক আগাম জাতের ধান ব্রি-৭৫ এবং ব্রি-৯০ চাষ করতে পারছে আগাম হিসেবে। তাতে করে ৮০ দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যেই তারা ফসল ঘরে তুলতে পারছেন। তাতে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। সেদিকেই এখন আমাদের ধাবিত হতে হবে। এখন পুরোদমে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় শুরু হয়েছে আগাম জাতের ধান কাটা। সেখানে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। তার কারণ নিয়মিত আমন আসতে এখন মাসখানেক বাকি। তাতে সেখানকার কৃষকরা কর্মহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছিল। কিন্তু আগাম আমনে তাদের সে দুর্দশা কেটেছে। সেখানে এখন ধানের বিচালির বিনিময়ে ধান কাটতে পারছেন। তাতে একদিকে আগাম জাতের ধানের জমির মালিককে নগদ অর্থ দিতে হচ্ছে না। আবার যারা ধানের বিচালির বিনিময়ে ধান কেটে দিচ্ছেন তাতে শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন অনেক বেশি। এক বিঘা জমির ধানে পাওয়া যায় ৬ হাজার টাকার বিচালি। তাতে করে একেক জনের রোজ হিসেবে তারা পান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মতো। অনেকের আবার গোয়াল ঘরে গরু থাকায় তাদের এ আগাম জাতের আমন যেন আশীর্বাদ হিসেবেই দেখা দিয়েছে। তার কারণ এখন পর্যন্ত নিয়মিত আমন আসতে অনেক দিন বাকি। তাদের গোখাদ্যেরও চরম অভাব রয়েছে। তাতে আগাম জাতের ধানের বিচালি গরুর খাবার হিসেবে যথেষ্ট চাহিদা থাকায় মালিক এবং শ্রমিক উভয়েই লাভবান হচ্ছেন। তাই কৃষিকে বাঁচাতে আগাম জাতের ধান চাষের বিকল্প কিছু নেই। এ বিষয়ে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের আরও এগিয়ে আসতে হবে। পুরো আমন আগাম চাষ করার পরও তারা আবার আগাম রবি ফসল আবাদ করতে পারছেন। তাতে করে মৌসুমের আগে যদি আলু উঠাতে পারেন তাহলে কৃষকের ঘরে ভালো কিছু অর্থ যোগ হতে পারে। আলু ছাড়াও রয়েছে সরিষাসহ নানা ধরনের রবিশস্য। তাই দুর্যোগকবলিত দেশের কথা চিন্তা করে দেশের কৃষি অধিদপ্তরকে আগাম ফসলের জন্য তাদের মাঠ ঢেলে সাজাতে হবে। নিতে হবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। এখন আগাম হিসেবে যে আমন ঘরে উঠছে তাতে বন্যার যেসব এলাকায় ধান মার খেয়েছে তাদের আর খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেবে না। তাই কৃষিকে বাঁচাতে নতুন করে মাঠ সাজানোর বিকল্প কিছু নেই। অপরদিকে, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯৪ হেক্টর জমিতে জমিতে আমনের আবাদ হয়েছিল। তাতে উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৬৪ লাখ মেট্রিক টন- যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। দীর্ঘদিনে ফসলের জমি কমলেও উৎপাদন ভালো হচ্ছে। তবে এ বছরও আমন ফসলের উৎপাদন ভালো পাওয়া যাবে বলে কৃষি অধিদপ্তরের আশা করছেন। আমাদের দেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই আমাদের খাদ্যের অন্যতম জোগানদাতা। তাই কৃষিকে এগিয়ে নিতে কৃষি উপকরণের পাশাপাশি আধুনিকযন্ত্রের উদ্ভাবনী প্রয়াসে অনেক গুরুত্বারোপ করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে আমাদের কৃষি কাজ করা সহজসাধ্য হবে বলে মনে হয় না। প্রাকৃতিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ও ঘূর্ণির তান্ডবে ভয়াবহ প্রতিকূলতার মধ্যে কৃষিকে এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তা হবে অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল সমীকরণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কৃষি শ্রমিক সংকট ভয়াবহ। তাছাড়া প্রাকৃতিক ঝড়ের কবলে বারবার পতিত হয়ে কৃষক এখন দিশেহারা। একজন দরিদ্র কৃষক এতটা ক্ষতি সহজেই পুষিয়ে উঠতে পারবেন না। তাই ভবিষ্যৎ কৃষি সহজীকরণ ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। তবে দেশের ৯৮ ভাগ জমির মাটি কর্ষণ করা হয় যন্ত্র দিয়ে। কিন্তু কম্বাইন হারভেস্ট নিয়েই সংকটের মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়। তা আবার ২০ ভাগের বেশি নয়। তাই কৃষককে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ধান পাকার সময়। তখন দুযোগ-দুর্বিপাক ঘনীভূত হয়ে আসে। অনেক সময় আধা পাকা ধান পর্যন্ত কাটতে হয় দুর্যোগের কারণে। তাই, এ ক্ষেত্রে আধুনিক কম্বাইন হারভেস্ট যন্ত্রের বিকল্প নেই। সময় এবং অর্থ বাঁচাতে দেশের কৃষিতে এ যন্ত্র ছাড়া ভাবাই যায় না। তবে এ যন্ত্রের দাম অত্যাধিক হওয়ায় কোনো কৃষকের পক্ষেই তা এককভাবে এবং সরকারি সহযোগিতা ছাড়া সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। ২০২০-২৫ অর্থবছরে জন্য সরকার ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। তার মধ্যে ১০ ধরনের কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকি দেওয়ার কথা। সরকার হাওড়াঞ্চলের কৃষকদের জন্য এ যন্ত্রে ৭০ শতাংশ এবং অন্য এলাকার কৃষকদের জন্য ৫০ শতাংশ ভর্তুকির ব্যবস্থা রেখেছেন। তবে কৃষির উন্নতি সাধন ঘটাতে হলে আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে সবার আগে। গড়ে তুলতে হবে আধুনিক কৃষিযন্ত্রের শিল্পকারখানা। কৃষির খরচ কমাতে আধুনিক যন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই কৃষির খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। তাছাড়া আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের ফলে একদিকে খরচ সাশ্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফসলের অপচয় রোধ করা যায়। দেশে আমন চাষের যে সময় সূচি থাকে তা করে রবিশস্য চাষ অনেক দেরি হয়ে যায়। যখন রবিশস্য ঘরে ওঠে তখন দাম থাকে পড়তির দিকে। আগাম আমন এবং আগাম রবি ফসলের আলু করা গেলে কৃষকের বাড়তি ভালো ধরনের কিছু পয়সা যোগ হয়ে থাকে। তাই আগামীতে আমন এগিয়ে এনে কৃষককে সুযোগ-সুবিধার বলয় তৈরি করে দিতে হবে। তাহলেই আমরা খাদ্য সংকটের উত্তরণ ঘটাতে পারব। অলিউর রহমান ফিরোজ : কলাম লেখক