দেশ গড়ার আগে নিজেকে গড়ুন
আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের দেশকে ভালোবাসা, দেশের উন্নয়ন, পরিবর্তন এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে নিজেদের গড়া এবং নিজ জায়গা থেকে দেশের জন্য অবদান রাখা।
প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ইসরাত জাহান
গাছের গোড়ায় পানি না ঢেলে, সার না দিয়ে যদি গাছের মাথায় ফল ঝুলতে দেখার স্বপ্ন দেখা হয় তাহলে এ স্বপ্ন আকাশকুসুম বৈ আর কিছুই নয়। একটা সংগঠনে সব সদস্য যদি দায়িত্বশীল এবং সক্রিয় না হয় তাহলে শুধু সংগঠনের সর্বোচ্চ পদের লিডাররা এককভাবে কখনোই কাজ করতে পারবে না এবং সংগঠনকে এগিয়ে নিতে পারবে না।
দরিদ্র পরিবারের ছেলে মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। সামর্থ্যের অভাবে ছেলের চাহিদা পূরণ অসম্ভব। এমতাবস্থায় ছেলের অভিভাবক প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এসে ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে অনুরোধ জানালেন। নবীজি পড়লেন বিপদে। তিনি নিজেই যে মিষ্টিপ্রিয়। তাই সেদিন ছেলেকে কিছু না বলে সাত দিন পর আসতে বললেন। ব্যস, এ কয়দিনে নিজের প্রিয় খাবারের অভ্যাসটুকু নিজেও ত্যাগ করলেন। যথারীতি পরামর্শ প্রার্থী ছেলেকে নিয়ে এলে তিনি বাস্তবতার বুঝ দিয়ে ছেলেকে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিলেন। অভ্যাস বদলের উপদেশ প্রদানের চেয়ে সুন্দর, শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত বোধ করি আর কিছু নেই। কাজেই 'নিজে না বদলালে কিছুই বদলানো যায় না' কথাটির প্রকৃত অর্থ-'আগে নিজের মজ্জাগত স্বভাব বা অভ্যাস বদলাও- পরে অন্যকে বা দেশকে বদলাতে বলবে'।
দেশকে সমৃদ্ধ আর সুশৃঙ্খল দেখার স্বপ্ন প্রতিটি নাগরিকই দেখে কিন্তু সেটা বাস্তবায়নের মৌলিক কাজ তাদের হাতেই- যা তারা কখনোই বিবেচনা করে না। দেশ পরিচালিত হয় কিছু মানুষের কর্মপদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে- অন্যদিকে, দেশ কাজ করে দেশের মানুষের জন্য, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য তাই সেই মানুষই আগে তৈরি হতে হবে- তবেই সামষ্টিক সফলতা আসবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত স্বাভাবিক নিয়মানুবর্তিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সচেতন থাকা, নিজে নিয়ম মেনে চলা এবং অন্যকে মানতে উৎসাহিত করা। প্রত্যেক পেশাজীবী যে যার অবস্থান থেকে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করা এবং পেশাগত সততার প্রমাণ দেখানো; দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা, সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা, যৌতুক না দেয়া, যৌতুক না নেয়া ; ঘুষ না দেয়া, না নেয়া।
বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, শিশুশ্রম ও সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানো, সরকার অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা, ভালো কাজ করলে ধন্যবাদ জানানো। তেমনি বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও- সরকারের খারাপ কাজের প্রতিবাদ না করলে বা জনগণের পক্ষে জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা না রাখলে নিন্দা করা আবার সরকারের ভালো কাজে পাশে না থাকলেও নিন্দা জানানো। অন্যকে দোষারোপ করার আগে আত্মসমালোচনা করা। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। এসব অভ্যাসগত পরিবর্তনই নৈতিক পরিবর্তনের চাবিকাঠি, দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যন্ত্র।
আমরা যদি ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জায়গায় সৎ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলি তাহলে দেশের প্রত্যেকটা কাঠামো পরিবর্তন ও দৃঢ় হবে।
কিন্তু আমাদের সমাজে লক্ষণীয়, একজন সেবক ডাক্তার কি তার পেশায় ঠিক আছেন? তিনি কি রোগীকে সর্বোচ্চ সেবাটি দিচ্ছেন? তিনি কি সপ্তাহে বা মাসে একবার নিজ এলাকায় গরিব রোগীদের বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছেন? আমরা দেখছি তার উল্টো চেহারা। ডাক্তারের কাছে রোগী আসা মানে আর্থিকভাবে তাকে অর্ধেক মেরে ফেলা। রোগীর অবস্থা না জেনে টেস্টনির্ভর কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন একজন মহৎ পেশার মানুষ! কত টাকা হলে তার বিলাসিতার সাধ মিটবে তা তিনি নিজেও বোধ হয় জানে না।
একজন শিক্ষকের কথাই বলি, কত টাকা চাই তার? টাকার কাছে বিবেককে বিক্রি করে একজন মানুষ গড়ার কারিগর কেমন মানুষ গড়বেন? একজন ব্যবসায়ীর কত টাকা দরকার ? দেশের মানুষকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে ফেলে দিয়ে ইচ্ছে মতো দাম বাড়াবেন, কমাবেন; ভেজাল মিশিয়ে উচ্চলাভের নেশায় মত্ত হয়ে যে শিশুর অনাগত ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত ও হুমকির মুখে ঠেলে দিলেন, আপনার শিশুটি কি এর বাইরে? কেন আমরা এসব করছি? তাই আগে নিজেকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
আমাদের সম্পদের সম্ভাবনায় সমৃদ্ধি সম্ভব। এই দেশজ চেতনায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। এ দেশে কিচ্ছু হবে না, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, সরকার এই করে দেয় না, সেই করে দেয় না- এসব হীনমানসিকতা আগে বদলাতে হবে। বদলাতে হলে চাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমিও পারব। আমার যা আছে তা নিয়েই এগিয়ে যাব। সরকারের পক্ষে সবকিছু করে দেয়া সম্ভব নয়। নিজেদেরও কিছু করার আছে। একা সম্ভব না হলে সমবেত প্রচেষ্টায় সম্ভব হবে। উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের দেশপ্রেম আর চেতনার জায়গাটি খুবই দুর্বল। দুষ্কৃতকারীরা এক হলেও আমরা এক হতে পারি না। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ অনেক ক্ষয়ে গেছে। একে অন্যের দুঃখে আগের মতো আবেগতাড়িত হই না। আজ এই বোধের জাগরণকে উসকে দেয়ার সময় এসেছে। এজন্য প্রয়োজন ধর্মীয় অনুশাসন আর পারিবারিক বন্ধনের অস্তিত্ব রক্ষা করা, নিজ জায়গা থেকে সমাজ এবং দেশের জন্য দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় দেওয়া; চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, কাজে-কর্মে নিজেদের প্রয়োজনে বদলে যাওয়া, বদলে দেওয়া। প্রত্যেক নাগরিক যদি হয় অধিকার সচেতন এবং দেশপ্রেমী তাহলে কখনোই দেশে স্বৈরাচারের উত্থান হতে পারবে না, রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি তাদের কাছে জবাবদিহি করতে অনুগত হবে- যা দেশকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তুলবে।
আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের দেশকে ভালোবাসা, দেশের উন্নয়ন, পরিবর্তন এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে নিজেদের গড়া এবং নিজ জায়গা থেকে দেশের জন্য অবদান রাখা।
ইসরাত জাহান : প্রাবন্ধিক