ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরবে কবে

আমরা যত্রতত্র নিদিষ্ট স্থান ব্যতিত হাত উঠিয়ে বাসে উঠব না এবং সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের যেসব ভূমিকা রয়েছে আমরা তা সঠিকভাবে পালন করার চেষ্টা করব।

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মুহাম্মদ সুলতান মাহমুদ
আধো রাতে যদি আমার ঘুম ভেঙে যায়, মনে পড়ে কোনো এক সময় আমাদের ঢাকা শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে আসবে। উন্নত গণপরিবহণ সেবা চালু হবে। যেখানে প্রতিটি যাত্রীবাহী বাস একটি নিদিষ্ট স্থানে নিদিষ্ট সময়ের জন্য থামবে। নিরাপদে যাত্রী নামবে, উঠবে। কোনো বাস নিদিষ্ট স্থান ছাড়া থামবে না। বাস চলা অবস্থায় দরজা থাকবে বন্ধ। রাস্তায় চলবে না কোনো ফিটনেসবিহীন লক্কড় ঝক্কড় বাস। যাত্রীবাহী বাস হবে নিরাপদ, আরামদায়ক ও পরিচ্ছন্ন। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের থাকবে না কোনো অভিযোগ। সব শ্রেণির মানুষ সুন্দরভাবে যাতায়াত করতে পারবে। বেপরোয়াভাবে চলবে না কোনো বাস। ঘটবে না কোনো দুর্ঘটনা। পথচারীরা থাকবে সুরক্ষিত। সর্বোপরি সব যানবাহন একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে। সাধারণত একটি দেশ কত উন্নত তার একটা বড় প্রমাণ মেলে সে দেশের নাগরিক পরিবহণ ব্যবস্থার দিকে তাকালে। ঢাকা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ঘনবসতিপূর্ণ যানজটের শহর। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। যেখানে ১১৩টি দুর্ঘটনায় ১২১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৩টি দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও ১১ জন আহত হয়েছেন। ঢাকার যানবাহনগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে না বললেই চলে। প্রতিনিয়ত রাজধানীতে বাসগুলো যাত্রী উঠানোর জন্য এক প্রকার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয় বাস চলন্ত অবস্থায় রাস্তার মাঝে যেখান থেকে যাত্রীদের নিরাপদ স্থানে বা ফুটপাতে আসতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এছাড়াও অন্য বাসের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি, ঘষাঘষি চলে- এর ফলে, বাসের লুকিং গস্নাস ভেঙে যায়, বাসের রং উঠে যায়। অনেক সময় জানালার গস্নাস পর্যন্ত ভেঙে যায়। এছাড়াও চালকরা রাস্তায় বাসগুলোকে বাঁকা করিয়ে রাখে যাতে পেছন থেকে কোনো বাস যেতে না পারে। তখন কোনো কারণ ছাড়াই সৃষ্টি হয় যানজট এবং এর ফলে, ঘটে বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় দুর্ঘটনা। এর কারণ হিসেবে অদক্ষ চালক, হেলপারকে দায়ী করেছেন বাস মালিকদের অনেকেই। আশির দশক থেকে ঢাকার গণপরিবহণের মূল ভরসা বাস। যাতায়াতের ৬৪ শতাংশ হয় বাসে। ঢাকায় প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি বাস এবং মিনিবাস চলাচল করে। এসব বাসের মালিক দুই হাজারের বেশি। মালিকদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক নেতাকর্মী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে রয়েছে। যার ফলে, তাদের ওপর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে, বাসগুলো ইচ্ছে মতো পরিচালনা হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থাকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য ছয়টি কোম্পানির মাধ্যমে চার হাজার বাস নামানোর পরিকল্পনা দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। কিন্তু তা বেশ কিছু জটিলতার কারণে আশার আলো দেখেনি নগরবাসী। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরানোর আশা নিয়ে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ৫০টি বাস নিয়ে চালু করা হয় নগর পরিবহণ নামে বাস সার্ভিস। ২০২২ সালে অক্টোবরে ২২ নম্বর রুটে চালু করা হয় ঘাটারচর থেকে ডেমরা (স্টাফ কোয়ার্টার) পর্যন্ত বাস সার্ভিস। এটি চালু করার পর কয়েকমাস ভালো সার্ভিস দিলেও এখন এর নাজেহাল অবস্থা হয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোর গণপরিবহণ ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, কীভাবে শহরের মানুষকে ভালো রাখা যায়, ভোগান্তি দূর করা যায় এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে আর অন্য দিকে, আমাদের দেশে ভোগান্তির শেষ নেই। বলা যায়, ঢাকার গণপরিবহণ ব্যবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় একদম তলানিতে অবস্থান করছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অনেকটা স্বস্তিদায়ক হলেও মেট্রোরেলের নিচের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতএব, দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তির জন্য ঢাকা মহানগরীর পরিবহণ ব্যবস্থাকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন, বিআরটিএসহ অন্যান্য যেই প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সমন্বিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তার পাশাপাশি যাত্রী হিসেবে আমাদেরও সচেতন হতে হবে। আমরা যত্রতত্র নিদিষ্ট স্থান ব্যতিত হাত উঠিয়ে বাসে উঠব না এবং সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের যেসব ভূমিকা রয়েছে আমরা তা সঠিকভাবে পালন করার চেষ্টা করব। মুহাম্মদ সুলতান মাহমুদ : কলাম লেখক