নতুন রূপে বাংলাদেশ, আর সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার প্রথা থেকে মুক্তি পেতে চায় সব স্তরের মানুষ। ছাত্র আন্দোলনের ফলে তৎকালীন সরকারের পতন আমাদের কিছু বিষয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে সব থেকে বড় বিষয় হলো একটি রাজনৈতিক দল যখন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার গঠন করে, তখন তাদের অধিকাংশ নেতাকর্মী ভুলে যায় সরকার এবং রাজনৈতিক দল এক নয়। যার কারণে ওই দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের সরকারের অংশ ভাবতে শুরু করে, আর দলীয় ক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকে এবং অনৈতিক ক্ষমতা চর্চা শুরু করে, এতে করে ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত থেকে দলীয় প্রতিশোধ নেওয়াতে। শুরু হয় হামলা, নামে-বেনামে মামলা, বসতবাড়ি ভাঙচুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ও হুমকি দেওয়াসহ আরো অনেক ধরনের অত্যাচার। যা খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে শিল্পপতি কেউ পছন্দ করে না।
ছাত্রদের এই গণআন্দোলন সব রাজনৈতিক দলকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্তা দিয়েছে। যেখানে মুখ্য বিষয় হলো: অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে রাষ্ট্রের মূলনীতি তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার উন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখিয়ে কারো বাকস্বাধীনতা হরণ করা যাবে না, সরকারের সঙ্গে অমিল হলে তাকে গুম বা খুনের ভয় দেখিয়ে জাতিকে দমিয়ে রাখা যায় না। ক্ষমতা ধরে রাখতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করলেও শেষ রক্ষা হয় না। বিশাল বিশাল দালান দেখিয়ে উন্নয়নের গীত গাইলে সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হওয়া যায় না, জনগণের পেটে লাথি মেরে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব না। চেয়ার ধরে রাখার জন্য অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েও সে চেয়ারে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। আমলাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে ক্ষমতায় বসা যায় কিন্তু টিকে থাকা যায় না। অত্যাচার অনাচার আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতা দখলে রাখা যায় কিন্তু জাতি যখন জেগে উঠে তখন লজ্জাজনকভাবে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। আর সে সময়ে নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনী কেউ রক্ষা করতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সিনিয়র নেতারা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, নরওয়েসহ অনেক দেশ রয়েছে যেখানে ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে এমন পার্থক্য বিদ্যমান থাকে যে, সরকার পরিবর্তন হলেও সরকারের কর্মকান্ডে কোনো পরিবর্তন হয় না- কারণ, এই নীতিতে জনগণের স্বার্থই সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকে সেইসঙ্গে বিরোধী দলগুলো জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে উন্নত ও উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দল সম্পূর্ণরূপে পৃথক হয়ে থাকে- যা স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।
\হদেশের জনগণ চায় তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। অর্থাৎ স্বাধীনভাবে নিজের অধিকারের কথা বলতে ও লিখতে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকে এমন ভারসাম্যপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা তৈরি করা। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যেন প্রত্যেক মানুষ তার ন্যায়বিচার পায়, নিজের প্রদেয় ট্যাক্স এবং ভ্যাটের টাকা দিয়ে পরিচালিত প্রতিটি দপ্তরে নির্বিঘ্নে সেবা গ্রহণ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে সেবার বিনিময়ে কেউ চা নাস্তার খরচ বা অন্যায়ভাবে কোনো বিনিময়ের কথা বলবে না। সরকার তার দলীয় কাজের তুলনায় নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকবে তথা দেশ ও জতির উন্নয়নের স্বার্থে মগ্ন থাকা, কারণ কেউ চায়না তার টাকায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রচারণা করা হোক। মানুষ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তার দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি দেখতে পছন্দ করে, কোনো নিদিষ্ট দলের ব্যক্তির চেহারা বা নাম নয়, সেইসঙ্গে বিভিন্ন স্থাপনার সামনে রাজনৈতিক ব্যক্তির ভাস্কর্য বা স্থাপনার নাম হিসেবে দলীয় মানুষের নাম ব্যবহার না করে জাতির সূর্য সন্তান বা ঐতিহাসিক প্রাপ্তি বা স্থানের নামে নামকরণ করা। বাংলাদেশের মানুষ এমন সরকার চায় না যে সরকার দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রকে রাজনীতি করনে বিশ্বাসী। মানুষ চায় রাজনীতি থাকবে মানুষের মনে ও রাজপথে, কারণ রাজনীতি কোনো পেশা নয়।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে বাংলাদেশের মূলনীতিকে সামনে রেখে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, সরকার ও রাজনৈতিক দল উভয়কে এক না করা, প্রতিশোধ পরায়ণ না হয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করার প্রতি আরো ইতিবাচক হতে হওয়া। সহিংসতা পরিহার করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে নিজ কিংবা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করা। সরকারি সেবা প্রদানকারী সব দপ্তরসমূহকে আপন গতিতে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। একই সঙ্গে এই দপ্তরগুলোকে কঠোর মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখা। জনপতিনিধিদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা না করে তার উদ্দেশ্যকে বিবেচনা করা। সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো।
দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর থাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট কাঠামোতে নিয়ে আসা। সেই সঙ্গে অন্যান্য সব বিষয়ে সাধারণ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়, সেই সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মো. আরিফ উলস্নাহ : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী