মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে তার গৃহীত পদক্ষেপ ও নীতিমালায় সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পাবে এবং তা নিশ্চিত হবে- জনগণের এটাই প্রত্যাশা।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ

উনিশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্র বড় ভূমিকা নিতে শুরু করে। আমলাতন্ত্র বস্তুত আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের স্থায়ী বা অরাজনৈতিক অংশই আমলাতন্ত্র বা সিভিল সার্ভিস নামে পরিচিত। গণতন্ত্রে নীতিনির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতারা এবং সেই নীতি বাস্তবায়ন করেন আমলারা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। বিগত কয়েক দশক ধরেই সিভিল সার্ভিসের সংস্কার বিশ্বব্যাপী আলোচনার একটা গুরুত্বর্পূণ বিষয়বস্তু হয়ে আসছে। কোনো কোনো দেশের প্রশাসনিক সংস্কার দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবও সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে আমলাতন্ত্রের পরিসরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন আমলাতান্ত্রিক দেশ ব্রিটেনে সরকারি র্কমর্কতা-র্কমচারী সংখ্যা প্রায় ৭.৫ লাখে উন্নীত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তিনটি পর্যায়ে ১৮০৮ সালে মোট র্কমর্কতা-র্কমচারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১২৬ জন, ১৯৭০ সালে তা ১২ লাখে উন্নীত হয়। ভারতে ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে সরকারি র্কমচারীদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৯.৪৫ লাখ ও ৪০.১২ লাখ। ভারতবর্ষের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে মিশ্র ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। কেউ কেউ এর মধ্যে সমাধানের তুলনায় সমস্যাই বেশি দেখতে পান। একদিকে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, অন্যদিকে, তারা বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবদ ট্যাক্সদাতাদের কাছ থেকে যে অর্থ গ্রহণ করেন প্রতিদানে তার সমপরিমাণ সেবা প্রদান করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের কাজের পদ্ধতি জটলি, তারা অদক্ষ; তাদের দুর্নীতি এতই ব্যাপক যে, তা সর্বজনীনতা প্রতিষ্ঠার হুমকি সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ভারতের পঞ্চম বেতন কমিশনের রির্পোটে এই অভিযোগগুলো করা হয়েছে। উলেস্নখ করা প্রয়োজন যে, একটি বেতন কমিশনের কাজ শুধু সরকারি কর্মচারী বেতন স্কেলে প্রদানের সুপারিশ প্রদান করাই নয়, এই কমিশন প্রশাসনিক সংস্কারের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সুপারশি ও পেশ করে থাকে। আমলাতন্ত্ররে অবয়ব হ্রাস করা ভারতীয় বেতন কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল। ভারত, পাকিস্তান কিংবা ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত সাবেক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র বা সিভিল সার্ভিসের প্রসার ও ব্যাপ্তি দ্রম্নত ও ব্যাপক। তাদের সেবার মানও অনেক নিচু। ট্রান্সপারন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের আমলাতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত ১ম শ্রেণির র্কমর্কতারাই হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সেবার পরিবর্তে শোষণের হাতিয়ারই হন বেশি।

১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের আমলাতন্ত্রের আকার ছিল ৪৫৪৪৫০ জন র্কমর্কতা-র্কমচারী নিয়ে গঠিত। ১৯৮২ সালে তা ৭৭৯০০০, ১৯৯২ সালে ৯৪৬৭৪৯ এবং ১৯৯৮ সালে ১০৪৫৪৪৭ জনে উন্নীত হয়। বর্তমানে আমাদের আমলাতন্ত্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। সরকারি আধাসরকারি ও করপোরেশেনগুলো ধরলে এ সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ হবে। আমাদের মোট, জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৫% এদের পেছনে ব্যয় হয়। এরা কি কাজ করেন জনগণ তা জানেন না। তবে তাদের অধিকাংশ যে ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না এবং ট্যাক্সদাতাদের জুলুম করেন এটা সর্বজনবিদিত। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং একে সেবামুখী ও অধিকতর কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার জন্য সম্ভবত পাকিস্তান আমল থেকেই (যেমন কর্নেলিয়াস রিপোর্ট) প্রচেষ্টা চলে আসছিল। তারই ধারাবাহিকতায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন কিছু কাজ করেছে এবং জনবল যৌক্তিকীকরণের জন্য সুপারশিও পেশ করেছে। এই সুপারিশসমূহের অংশবিশেষ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এই সুপারিশ সবগুলো যে মেনে নেয়ার মতো তা নয়। তবে জনগণের র্দুদশা লাঘব এবং সরকারি সেবা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাকে সহজ ও ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ হিসেবে আমলাতন্ত্রের কাঠামো পুর্নগঠন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পদোন্নতি দিয়ে এমন অবস্থায় সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এখন কর্মর্কতাদের বসার স্থানও নেই। পদোন্নতি দেওয়ার জন্য কাজ ছাড়া অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের সন্তুষ্ট রেখে সরকার বারবার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শুধু প্রমোশন নয়, তাদের বেতন ভাতাও পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমলারা এখন মানুষের সেবক নয়, সরকারের সেবাদাসে পরণিত হয়েছে। এই অবস্থার আমুল সংস্কার প্রয়োজন।

প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন সংস্কার একে অন্যের পরিপূরক। যেহেতু পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক কাঠামোগত কমিশন বিধায় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনকে এই পরিকাঠামের আওতায় অঙ্গীভূত করে একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা দিয়ে দাঁড় করানো যেতে পারে অথবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করে এই কাউনসিলের আওতায় প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ সংস্কার কমিশন নামে একটি আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। অধিকন্তু প্রশিক্ষণ প্রশাসনের আওতায় প্রশাসন কমিশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের সংস্কার কাজ চলমান রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ওই কাউন্সিলের নাম হতে পারে জাতীয় প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ কাউন্সিল। যদিও আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জাতীয় প্রশিক্ষণ কাউন্সিল নামের একটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব কাউন্সিল আছে- কিন্তু এ কাউন্সিলের কোনো কার্যকারিতা নেই। যাইহোক, প্রশাসনিক এই কমিশনকে কাজ করতে হবে। মোটামুটিভাবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, শিক্ষা কমিশন, নির্বাচন কমিশন বিগত দিনে সংস্কারের যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে কমিশনগুলো কোনো কৃতিত্বের স্মারক প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। কমিশনের ভালো-মন্দ দিকগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে। নতুন করে কোনো ট্রায়াল-এ্যারর ম্যাথড বা প্রজেক্ট দিয়ে শুধু সময়ক্ষেপণ হবে। তবে বিগত দিনের কর্মকৌশল বর্তমান ও একবিংশ শতাব্দির সামনের দিনগুলোর জন্য সময় উপযোগী প্রশাসনিক সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি হতে পারে। নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিতে প্রবেশ করলে নতুন চাকরিপ্রাপ্তদের প্রবেশন পিরিয়ড দীর্ঘ করতে হবে। এ সময় তাদের যোগ্যতা ও সততা গোপনভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এ কাজে প্রয়োজনে স্টিং অপারেশনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। প্রশাসক জনগণকে সেবা প্রদানের কাজে গুরুত্ব কমিয়ে নিজের উন্নয়নে যাতে কাজ না করতে পারেন, তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও সংস্কারের ধারে কাছেও ছিল না। একজন স্বৈরাশাসকের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্ষমতা বা পদে আসীন থাকতেই তারা বিভোর ছিলেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রচলিত কোটাকে খেয়ালখুশিমতো অপব্যবহার করে মেধার কোটাকে নষ্ট করেছে। বিগত স্বৈরাশাসকের আমলে ছাত্রলীগ নামক কোটার প্রবর্তন করে এ বর্ণিত কমিশন অনেক অনিয়ম করেছে। বিগত সরকারের আমলে একটি মাফিয়া চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অনৈতিক কাজে জড়িত থেকে লখো কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে শুধু বিসিএস পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতার ও পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলে না। এ কমিশনকে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক একটি বার্ষিক পদোন্নতি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে যথাযথ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং বিগত সময়ের বার্ষিক কর্মকান্ডের রিপোর্টের ভিত্তিতে মেধাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের উচ্চতর পদে নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দরকার ছিল। কমিশন এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়্যারম্যান ও সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের মতো পদত্যাগে বাধ্য করাতে হবে এবং সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্বায়ত্তশাসিত শক্তিশালী কমিশনে পরিণত করতে হবে। আমলাতন্ত্রকে সেবামুখী ও জনবান্ধব করা একটি দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এজন্য সর্বপ্রথমে আমলাদের যোগ্যতা সুনিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় হাত দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সুযোগ্য শিক্ষার্থীরা আমলাতন্ত্রে প্রবেশ করতে পারবেন। তারপর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাদের নিয়োগ পদ্ধতিতে। বর্তমানের বিসিএসে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার নম্বর অনেক কমিয়ে দিতে হবে। মুখস্থ বিদ্যানির্ভর এমসিকিউ পদ্ধতির প্রচলন বন্ধ করতে হবে।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র তার নখদন্ত প্রবলভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে বিগত সব সরকারের আমলে। আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য দেখে অনেকে একে 'আমলাশাহী'ও বলে থাকেন। মিশেলসের তত্ত্ব অনুযায়ী দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র পরিণত হয় গোষ্ঠীতন্ত্রে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করে ফেলে। আমাদের দেশে আমলাদের তেমন রূপই আমরা বারবার দেখেছি। আমরা জানি, অগণতান্ত্রিক সরকার আমলানির্ভর হয়। ফলে, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন দক্ষ আমলাতন্ত্র। সেই আমলাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন- এমনটাই প্রত্যাশা। অন্যথায়, প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য- যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। জাতীয় সেবা ও স্বার্থের পরিপন্থি আমলা তোষণ নীতিকে আমাদের কোনো অবস্থাতেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। তাই আসুন মেরুকরণ নয়, আমরা সবাই মিলেমিশে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সুন্দর, সাবলীল ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনে সচেষ্ট হই। এর অন্যথা হলে গণতন্ত্র বিকাশের পথে আসবে প্রতিবন্ধকতা। গণতন্ত্র হবে ভূলুণ্ঠিত। মুখথুবড়ে পড়বে অংশগ্রহণ প্রতিনিধিত্বের সংস্কৃতি। পরিশেষে আমলা, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি সবপক্ষকে দেশমাতৃকার সার্বিক কল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। সেই উপলব্ধির জাগরণ ঘটুক- এটাই আজ সাধারণের প্রত্যাশা। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কারে দলীয় সরকারের রাজনৈতিক মত ও স্বার্থ বড় ভূমিকা রেখে আসছে। সময়ের প্রয়োজনে প্রশাসন ব্যবস্থায় সংস্কার অপরিহার্য। তবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে ক্ষমতাসীন সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে সংস্কার যেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পরীক্ষিত বৈশিষ্ট্যাবলি যথা- নিরপেক্ষতা ও সততার অবসান ঘটিয়ে তাদের দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারীতে পরিণত না করে।

বর্তমান প্রশাসনিক কমিশনের প্রধান মো. মুঈদ চৌধুরী একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ ও কর্মতৎপর মানুষ। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত তার কমিশনের সদস্যরা প্রায় সবাই হচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা। প্রশাসনিক সংস্কারক শুধু প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে? প্রশাসনের ক্ষেত্র ব্যাপক ও বিস্তৃত। চিকিৎসা প্রশাসন, প্রকৌশল প্রশাসন, প্রযুক্তি প্রশাসন, খাদ্য প্রশাসন, ব্যবসা প্রশাসন ইত্যাদি সব জায়গাতেই প্রশাসনের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা য়ায়। সেজন্য প্রশাসনিক এ সংস্কার কমিটিতে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অধিকারী তা ভাবার সুযোগ নেই। এরকম পরিস্থিতিতে এ কমিটি সচেতন নাগরিক সমাজের কাজে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ কমিটি প্রশাসন ক্যাডারের প্রতি দুর্বল থাকবে এবং সেভাবেই প্রশাসনকে ঢেলে সাজাবে। যা বিগত দিনে ঘটেছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, অবহেলা অনিয়ম এবং কর্তৃত্বের বাহাদুরিতে নিমজ্জিত থেকে স্বার্থপরতা তোসামোদিতে ব্যস্ত থাকেন এ শ্রেণির মানুষ। সর্বোপরি পিএসএসি বা বিভিন্ন কমিশনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা প্রশাসন ক্যাডারের হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সব নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে তথা ডিপিসি এবং এসএসবিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। প্রশাসনের সব স্তরে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী আমলাদের যথোপযুক্ত স্থানে বসিয়ে পেশাদারিত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি জনবান্ধব ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই ঘুষ, দুর্নীতি যেমন কমে যাবে, তেমনি সরকারের পক্ষেও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হতে পারে। উপনিবেশিক প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র সামাজিক বৈষম্যের জন্য দায়ী- একথা নির্জলা সত্য। তবে প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এ সরকার প্রশাসনিক সংস্কারে সামাজিক বৈষম্যের আবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। পরিশেষে স্থানীয় প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা মাথায় রেখে দুটি অ্যাপ্রোচ যথাক্রমে নিউ প্যাবলিক ম্যানেজমেন্ট (এনপিএম) ও নিউ প্যাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনপিএ) এর সমন্বয়ে দেশে ব্যবসা-অনুকূল ও স্ববান্ধব একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়া তোলার এখনই সময়। এক্ষেত্রে দৃঢ় রাজনতৈকি অঙ্গীকারের অভাব হলেও এ সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতায় মৌলিক সংস্কার অনেকটাই সম্ভব।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে তার গৃহীত পদক্ষেপ ও নীতিমালায় সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পাবে এবং তা নিশ্চিত হবে- জনগণের এটাই প্রত্যাশা।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে