ছাত্ররাজনীতির কালো অধ্যায়

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মো. আবদুর রহিম
রাজনীতি প্রত্যেকের সাংবিধানিক অধিকার। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলও মানুষকে রাজনৈতিক জীব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রাজনীতি মানুষের চিন্তাজগৎকে প্রসারিত করে এবং নিজের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এজন্য বলা যায়, মানুষের সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতির অন্যতম একটি শাখা হলো ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতিকে সাধারণ অর্থে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে নেতৃত্ব গুণ সম্পূর্ণ হওয়া এবং পরবর্তীতে দেশ পরিচালনার যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠার অন্যতম মাধ্যম। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একেবারেই ভিন্ন। স্বাধীনতার পর থেকে ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। দলগুলো হয়ে ওঠে এক একটি ক্যাডার ও পেটুয়া বাহিনীতে। বিরোধী দলের টুটি চেপে ধরা, হত্যা, মারামারি, হানাহানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিট বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গেস্টরুম সংস্কৃতি, লুটতরাজ, ইভটিজিং, মাদক পাচার, শিক্ষক অপদস্থ করাসহ সব অপকর্মই হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতির প্রধান কাজ। যেই ছাত্রনেতাদের দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করা, তারাই হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের ওপর এক একজন হায়েনাস্বরূপ। হলের সিট, ক্যান্টিনের খাবার, ক্যাম্পাসের দোকান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, প্রশাসনিক কাজের টেন্ডার সব জায়গাতেই বসায় তাদের থাবা। স্বাধীন এই বাংলাদেশের ইতিহাসই শুরু হয় ছাত্ররাজনীতির ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের এক নিকৃষ্ট অধ্যায় দিয়ে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কর্তৃক ৭ জন ছাত্রকে সূর্যসেন হল থেকে তুলে নিয়ে মহসিন হলে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। এটা তো ছিল সূচনা মাত্র। এরপর শুরু হয় একে একে হত্যাকান্ড। ছাত্ররাজনীতির ক্যাডাররা পৈশাচিক কায়দায় কেড়ে নেয় আবরার ফাহাদের মতো অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রাণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ জন করে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী খুন হন। আর এসব খুনের অধিকাংশই হয় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায়। শুধু হত্যাকান্ড নয়। পাশাপাশি চলে তাদের আরও অনেক অনৈতিক কার্যক্রম। প্রায় সময় নারী শিক্ষার্থীরা এসব নেতাদের টার্গেটে পরিণত হয়। যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে, বলা যায় সেই দলের ছাত্র নেতারাই চলে আসে ধর্ষক ও ইভটিজারের ভূমিকা। ১৯৯৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেসময়ের ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা কর্তৃক পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনা নিয়ে সেসময় অনেক তোলপাড় হলেও, আদৌ কোনো বিচার হয়নি। এর কিছুদিন পর ঐ একই নেতা ১৯৯৫ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের আরেক ছাত্রীকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। শুধু এই দু'টি ঘটনা নয়, এমন অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্রনেতাদের দ্বারা। ১৯৯৭ সালে ১০০টি ধর্ষণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসীমউদ্দিন মানিক প্রকাশ্যে ১০০তম ধর্ষণ উপলক্ষে কেক কেটে তা উদযাপন করে। এভাবেই স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি ক্যাম্পাসে প্রশাসনের নাকের ডগায় ক্ষমতার দাপটে নারী শিক্ষার্থীদের জীবনকে নরকে পরিণত করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের আরেকটি হীন কাজ হলো বিরোধী দল ও সরকারবিরোধী যে কোনো যৌক্তিক সমালোচনা দমন করা। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাকস্বাধীনতাটুকুও কেড়ে নেয়। বিরোধী দলের বা অন্য দলের ছাত্রনেতাদের ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনায় বাঁধা প্রদান, ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাঁধা প্রদান, সরকারের অযৌক্তিক বা জনগণের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম নিয়ে কেউ কথা বললে বা কোথাও লিখলেই তাকে বিরোধী দল বা জঙ্গি বা শিবির ট্যাগ দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাদের এসব নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয় আবরার ফাহাদের মতো অনেক শিক্ষার্থী। আবার কেউ কেউ এসব নির্যাতনের ফলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর যারা জীবিত ছিল, তাদের অধিকাংশকেই অ্যাকাডেমিক লাইফ শেষ না করেই ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রত্যেকটি হল ও ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের কাছে জিম্মি। হলগুলোতে গণরুম, গেস্টরুম কালচার, ক্যাম্পাসের্ যাগিং কালচারের মাধ্যমে অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেওয়া হয় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, হল ক্যান্টিন, ক্যাম্পাসের দোকান, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে সব জায়গায় চলে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। অন্যদিকে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা যেখানে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার কথা, আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকার কথা, সেখানে তারা পালন করে তাদের মাদার সংগঠনের লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকা। '১৮-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, '২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এর অন্যতম উদাহরণ। প্রতিটি আন্দোলনেই তারা হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। শুধু '১৮ বা '২৪ই নয়, সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা ছিল এই ভূমিকায়। ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের শাসনামলেও মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলে ছাত্রদলের নেত্রীদের সহযোগিতায় পুরুষ পুলিশ সদস্য প্রবেশ করে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও লাঞ্ছনা করে। এতে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী আহত ও লাঞ্ছনার শিকার হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই ছাত্ররাজনীতির এই ধ্বংসাত্মক কাজের ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। ফলে ঝরে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী। প্রাণ দিয়েছে অনেকে। ধর্ষণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয়েছে অনেককে। বারবার রক্তাক্ত হয়েছে দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। তাই '২৪-এর অভু্যত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি ক্যাম্পাসগুলোতে থাকা না থাকার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং সব ধরনের দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে প্রকটভাবে। মো. আবদুর রহিম সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা