দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন এক উৎসব

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

শেখর ভট্টাচার্য
সর্বজনীন দুর্গাপূজা কী আর সর্বজনীন আছে? দুর্গাপূজা এখন আর সর্বজনীন নয়, দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হয়ে পড়েছে। সর্বার্থেই দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইউনেস্কো জানায়, দুর্গাপূজা তাদের শিল্প ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তালিকাভুক্ত হয়েছে। কলকাতার দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হলে তো সারা পৃথিবীর দুর্গাপূজাই বিশ্বজনীন হয়ে পড়ে। মা দুর্গার আরাধনা এবং উৎসবের আনন্দের রং তো সারা বিশ্বে একই রকম। ভাব, ভক্তি, উদযাপনের মধ্যে খুব বেশি কী পার্থক্য আছে? মোটেই নেই। ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল হেরিটেজের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০২২-এর দুর্গাপূজা খুব তাৎপর্যবহ হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্বজুড়ে উদযাপিত দুর্গাপূজার সংগঠকরা কী এ বিষয়ে সচেতন আছেন। বিশ্বায়নের কারণে পৃথিবীর সব মহাদেশ এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। ইংরেজিতে আমরা বলি গেস্নাবাল ভিলেজ। আজ ঢাকা-কলকাতা, লন্ডন প্যারিস, নিউইয়র্ক কিন্তু পরস্পরের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। রূপক অর্থে এবং ভৌগোলিকভাবে হয়তো সাত সমুদ্দুর তের নদীর পার, প্রযুক্তির শক্তিতে বাড়ির পাশের আরশিনগর। দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হওয়ার আর একটি কারণ হলো সারা বিশ্বে বাঙালি হিন্দুদের ছড়িয়ে পড়া। আর বাঙালি হিন্দু যেখানে সেখানেই তাদের প্রধান উৎসব সাধ্য অনুযায়ী জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়ে থাকে। ভাবলে অবাক হতে হয়, মালেয়েশিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশেও দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে গত ১০ বছর থেকে। দুর্গাপূজাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কো কী বলেছে? দুর্গাপূজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সম্পর্কে ইউনেস্কো বলছে, 'দুর্গাপূজা হলো ধর্ম ও শিল্পের সর্বজনীন অনুষ্ঠানের সর্বোত্তম উদাহরণ এবং শিল্পী ও নকশাকারীদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। এই উৎসব পৌর অঞ্চলে বৃহৎ স্থাপনা ও মন্ডপের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ঢাকের বাদ্য ও দেবীর পূজা দ্বারা পরিচিত। এই উৎসবে শ্রেণি, ধর্ম ও জাতি ভেদাভেদ মুছে যায়।' ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে দুটো বিষয় খুব স্পষ্ট, একটি হলো দুর্গাপূজার মানবিক দিক যেটি তাদের বিমোহিত করেছে তাদের ভাষায় দুর্গাপূজা উদযাপনে সনাতন ধর্মীয়রা শ্রেণি, ধর্ম ও জাতিভেদকে ভুলে যায়। আমাদের এখন ভাবতে হবে সত্যি কী আমরা সমতার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, পূজার মাধ্যমে শ্রেণি, ধর্ম ও জাতিভেদকে ভুলে যাই। দুর্গাপূজা কী আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। বুঝতে কষ্ট হয়। মনে হয়, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকে দৃশ্যমান করতে আরও সময়ের প্রয়োজন। তবে শ্রেণিভেদ, বর্ণভেদ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর বিষয়টি নিয়ে পূজা সংগঠক এবং সমাজকর্মীদের আরও সচেতন হতে হবে। পূজার আয়োজনের সঙ্গে যদি সচেতনা সৃষ্টির কর্মসূচিকে যুক্ত করা হয় তাহলে বিশ্বজনীন দুর্গাপূজা উদযাপনের উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হবে। লেখাটিকে সচেতনভাবে তত্ত্বের ভারে ভারাক্রান্ত করতে চাইনি। তারপরও জগৎ জননী মা দুর্গার মহিমা নিয়ে কিছু বলা না হলে, লেখাটির মূল উদ্দেশ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না। যুবরাজ হ্যামলেট ছাড়া তো শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটক মঞ্চায়ন করা যায় না। দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার উদ্ভব, তার মর্তে আগমনের উদ্দেশ্য, তার রূপের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা না করলে ভুবন মোহিনী, করুণাময়ী মাকে নিয়ে কোনো আলোচনাই উদ্দেশ্যমুখী হতে পারে না। আগেই বলেছি, দেবী দুর্গা হলেন, দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজোরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকেই আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত দেবী দুর্গা অসুরকুলকে বধ করে স্বর্গ তথা বিশ্বব্রহ্মান্ডে শান্তি স্থাপন করেন। দেবী দুর্গা মহামায়া, মহাকালী, মহালক্ষ্ণী, মহাসরস্বতী, শ্রীচন্ডী প্রভৃতি নামেও পরিচিত। সর্বশক্তির আধার আদ্যশক্তি হলেন- মা দুর্গা। মা দুর্গা নামের মধ্যেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি দুর্গমাসুর নামক এক দৈত্যকে বধ করে দুর্গা নামে খ্যাত হন। মা দুর্গা শত্রম্নর কাছে, পাপির কাছে যেমন ভয়ংকর, তেমনি সন্তানের কাছে তিনি স্নেহময়ী। ঈশ্বরের মাতৃরূপের নাম হচ্ছে- মা দুর্গা, দেবী মহামায়া। দেবী দুর্গা ১০৮টি বিশ্লেষণে ভূষিত হন। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র অকালে ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা করেছিলেন। রামচন্দ্র অকালে দেবী দুর্গার বোধন করে যে পূজা করছিলেন, বর্তমানে আমরা সেটাই অনুসরণ করছি। রামচন্দ্র শরৎকালে যে দুর্গাপূজা করেন সেটাকে বলা হয় অকালবোধন। নিদ্রিত সময়ে দেবতাদের জাগ্রত করাকেই বলা হয় অকালবোধন। রাবণের লঙ্কা থেকে প্রিয়তমা স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের জন্য ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। অসুরদের রাজা মহিষাসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা হলেন মহিষাসুর মর্দিনী। তিনি আদ্যশক্তি মহামায়া। সব পাপ ও অন্যায় কাজের আধার অসুর নিধন করে দেবী দুর্গা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাতে দুর্গাপূজা নিয়ে যতই হৈ হট্টগোল হোক না কেন, দুর্গাপূজা কিন্তু সূচিত হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশে। সাহিত্যিক রাধারমণ রায়ের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, আকবরের রাজত্বকালেই ১৫৮০ সাল নাগাদ তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলাদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেন। তা হলে কংসনারায়ণের পূর্বে শারদীয়া দুর্গাপূজার অস্তিত্ব কি ছিল না? রাধারমণ রায়ের মতে, আগে এ দেশে বসন্তকালে হতো দুর্গাপূজা আর শরৎকালে হতো নবপত্রিকা পূজা- যার স্থান আজ গণেশের পাশে। নবপত্রিকাই কালক্রমে চার পুত্র-কন্যাসহ দেবী দুর্গার মৃণ্‌ময়ী মূর্তিতে রূপান্তরিত। যেহেতু আকবরের রাজত্বকালেই কংসনারায়ণ মূর্তি গড়ে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন, তাই অনুমান করা চলে এর আগে ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণ জাঁকজমকপূর্ণ যে বাসন্তী পূজা করতেন সে পূজাটি সাধারণ মানুষের কাছে উৎসব হিসেবে সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়নি। বাসন্তীপূজা উৎসব হিসেবে গৃহীত না হওয়ার আর একটি কারণ আছে, তাহলো নিজেদের জৌলুস এবং প্রভাব বৃদ্ধির জন্য জমিদারেরা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করে বাসন্তী পূজার আয়োজন করতেন। এ কথার অর্থ এই নয় যে, মা-দুর্গা, মা বাসন্তীর থেকে বড় বা ছোটো দেবী। সনাতন ধর্মের অনুসারীদের কাছে দুর্গা এবং বাসন্তী দু'জনই পুজ্য, তবে কালের বিবর্তনে উৎসব হিসেবে দুর্গাপূজা নানা কারণে শ্রেণি, বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে গৃহীত হয়ে পড়েছে। সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণে দুর্গাপূজার কোনো উলেস্নখ ছিল না। কিন্তু রামায়ণ যখন বাংলা ভাষায় অনূদিত হলো তখন থেকেই মূলত দেবী হিসেবে দুর্গার মহাত্ম্য বাংলাভাষী হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ৬০০ বছর আগে কৃত্তিবাস ওঝা যখন রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করেন, তখন লোকায়ত গল্পে দুর্গার যে কাহিনী প্রচলিত ছিল, সেটি অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর যেহেতু বাঙালি বাংলা ভাষায় রামায়ণ পেল এবং সেখানে দেখল দুর্গার সাহায্যে রামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণকে বধ করতে পারে, তাহলে এ রকম মাতৃ সাধনা বাঙালির প্রাত্যহিক আয়োজনে ও প্রয়োজনে থাকবে না কেন, এ ধরনের একটি শুভ ইচ্ছা থেকেই বাঙালি দুর্গাপূজাকে সাদরে গ্রহণ করে ফেলে। এভাবেই মা দুর্গা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রধানতম দেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পড়েন। এরপরও প্রধান ধর্মীয় উৎসব হয়ে উঠতে দুর্গাপূজার সময় লেগেছে আরও কয়েকশ' বছর। ফিরে আসি দুর্গাপূজার বিশ্বজনীনতা প্রসঙ্গে। মা দুর্গা হলেন, দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারী। তিনি অন্যায় অসত্যের প্রতীক মহিষাসুরকে নিধন করার জন্যই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে অন্যায়, অসত্য, যুদ্ধবিগ্রহের এই ক্রান্তিকালে মা দুর্গার আদর্শ কিন্তু আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মাতৃ আরাধনার উদ্দেশ্যকে সফল করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি পূজার আয়োজন যদি নিবেদিত হয় তাহলে দুর্গাপূজারর মাহাত্ম্য সমস্ত বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে গৃহীত হবে এবং বিশ্ববাসী মাতৃ আরাধনার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সমর্থ হবে খুব সহজেই। দুর্গাপূজা তাই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি বৈশ্বিক সংহতি রক্ষায় এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ানুগ একটি পূজা। পৃথিবীর সব রাবণরূপী অসুরদের বিনাশের জন্য দেবী দুর্গার আরাধনার গুরুত্ব অসীম। 'রাবণস্য বিনাশায় রামসানুগ্রহায় চ অকালে বোধিতা দেবী।' অর্থাৎ রাবণকে বিনাশের জন্য রামের প্রতি অনুগ্রহবশত অকালে দেবী দুর্গা বোধিত হয়েছিলেন। দুষ্ট শক্তি রাবণকে বধ করার জন্য রাম নিদ্রিত সময়ে দেবীর পূজা করেছিলেন অকালবোধনের মাধ্যমে। আমাদের অন্তরের রাবণকে বিনাশ এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তাই দুর্গাপূজার আয়োজন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ভক্তিসহকারে করা উচিত। শেখর ভট্টাচার্য প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক