জগৎ জননী দেবী দুর্গা
সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, কৈলাস শিখর ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা মা দুর্গার অকাল 'বোধন' ভোরের শিউলি ছড়াচ্ছে মোহনীয় গন্ধ। এমন শারদীয় আবহেই শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।
প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মন্তোষ চক্রবর্তী
বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ষষ্ঠীতে দেবী বোধনের পর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্যে দিয়ে দেবী দুর্গা অধিষ্ঠান হয় প্রতিটি পূজামন্ডপে। টানা তিন দিন পূজার পর দশমীতে দেবী বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনের সর্বজনীন এ উৎসব।
এই মহোৎসব বা দুর্গাপূজা মূলত মহালয়া থেকে ক্ষণ গণনা শুরু হলেও শারদোৎসবের আগমনী বার্তা জানিয়ে দেয় শরতের কাশফুল। তারপর শরতের শিউলি পুষ্পের স্নিগ্ধ ঝরা সকালে শারদ লক্ষ্ণীকে বরণের বার্তা দেয় শিউলি ফুল, ঠিক এই সময়ে বাঙালির মন ভরে এক অন্যরকম আনন্দে। খুশির বীণে কম্পিত হয় প্রতিটি প্রাণ।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এই ঋতুতেই উদযাপিত হয়। ধর্মমত নির্বিশেষে এই ঋতু মানুষকে জড়িয়ে রাখে এক মায়াবী বন্ধনে। এই সময় দূরের স্বজনরা ঘরে ফিরে। বাঙালির যা কিছু নিজস্ব তার মধ্যে শারদোৎসবের একটি নির্দিষ্ট স্থান আছে।
দুর্গাপূজা মূলত শুভশক্তি আবাহনের পূজা। প্রতিটি পূজা বা পার্বণের নির্দিষ্ট তিথি বা সময় আছে। তেমনি দুর্গাপূজাও একটি। তবে শারদীয় দুর্গাপূজা সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। এই সর্বজনীন দুর্গাপূজাকে ঘিরে দেশ মহাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে সৌহার্দ্য ও সম্প্র্রীতির এক অনন্য মেলবন্ধন। আমাদের দেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আশ্বিন মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি থেকে দশমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার আরাধনা করে থাকে।
দেবী দুর্গা হলেন দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজোরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকেই আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। দিব্যে অস্ত্রে সজ্জিত দেবী দুর্গা অসুরকুলকে বধ করে স্বর্গ তথা বিশ্বব্রহ্মান্ডে শান্তি স্থাপন করেন। দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া, মহাকালী, মহালক্ষ্ণী, মহাসরস্বতী, শ্রীচন্ডী প্রভৃতি নামেও পরিচিত।
সর্বশক্তির আদ্যশক্তি হলেন মা দুর্গা। মা দুর্গা নামের মধ্যেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি দুর্গমাসুর নামক এক দৈত্যকে বধ করে দুর্গা নামে খ্যাত হন। মা দুর্গা শত্রম্ন ও পাপীর কাছে যেমন ভয়ংকর তেমনি সন্তানদের কাছে তিনি স্নেহময়ী জগৎ জননী।
দেবী দুর্গা ১০৮টি বিশেষণে ভূষিত হন। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র অকালে ১০৮টি নীলপদ্ম ফুল দিয়ে দেবীর পূজা করেছিলেন। বর্তমানে আমরা রামচন্দ্র অকালে দেবী দুর্গার বোধন করে যে পূজা করছিলেন সেটাই অনুসরণ করছি। রামচন্দ্র শরৎকালে যে দুর্গাপূজা করেন সেটাকে বলা হয় অকালবোধন। নিদ্রিত সময়ে দেবতাদের জাগ্রত করাকেই বলা হয় অকালবোধন।
রাবণের লংকা থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রীরাম চন্দ্র শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। আর অন্য যে দুর্গাপূজা যেটা ছিল মূল পূজা সেটা এখন বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। অসুরদের রাজা মহিষাসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা হলেন মহিষাসুর মুর্দিনী। তিনি আদ্যশক্তি মহামায়া। সব পাপ ও অন্যায় কাজের অসুর নিধন করে দেবী দুর্গা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পাপীদের বিনাশে দেবী রণসাজে সজ্জিত হয়ে বিনাশ করেন বলে দেবী রণদেবী। পশুরাজ সিংহ দেবীর বাহন। সঙ্গে দুই পুত্র সেনাপতি কার্তিক ও সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং দুই মেয়ে ধনের দেবী লক্ষ্ণী ও বিদ্যার দেবী সরস্বতী। দেবী দুর্গার চার সন্তানের সঙ্গে ধর্ম, অনন, কাম ও মোক্ষ জড়িত। দেবী স্বামীগৃহ কৈলাস থেকে পিত্রালয় মর্তে বেড়াতে আসেন প্রতি বছর আশ্বিন মাসের পঞ্চমী তিথিতে। দেবীর তিনটি চোখ বলে তাকে ত্রিনয়নী বলা হয়। দেবীর বাম চোখ চন্দ্র, ডান চোখ সূর্য এবং কপালের চোখ অগ্নিকে নির্দেশ করে। দেবী দুর্গার ১০ হাতে অস্ত্র শক্তির প্রতীক। দেবীর বাহন সিংহ শক্তির ধারক। বিজয়ার দিনে মহিষাসুরকে বধের মাধ্যমে বিজয়ের উৎসব পালিত হয়। বিজয়া দশমী হলো ঐক্যের প্রতীক, ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিন। বিজয়ার দিনে অনেকেই পূর্ব শত্রম্নতা ভুলে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় এবং বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি বৈশ্বিক সংহতি রক্ষায় এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দুর্গাপূজার গুরুত্ব অনেক। দেবী দুর্গা মানুষের দুর্গতি নাশ করেন বলে তার নাম দুর্গতিনাশিনী।
'রাবণস্য বিনাশায় রামসানুগ্রহায় অকালে বোধিতা দেবী' অর্থাৎ রাবণকে বিনাশের জন্য রামের প্রতি অনুগ্রহবশত অকালে দেবী দুর্গা বোধিত হয়েছিলেন। দুষ্টশক্তি রাবণকে বধ করার জন্য রাম নিদ্রিত সময়ে দেবীর পূজা করেছিলেন অকালবোধনের মাধ্যমে। দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে দেবীর নাম হয়েছিল দুর্গা।
দেবীর বোধন :
কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গাপূজার বোধন ও পূজা করেছিলেন। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে পরিচিত। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন, এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে, দেবী পক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়। এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা ও বার্ষিক লক্ষ্ণীপূজার দিন হিসেবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচ দিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্ণীপূজায় তার সমাপ্তি হয়। এক বছর পর পর উমা স্বামীগৃহ কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে মা-বাবার বাড়িতে আসেন। তারপর আবার ফিরে যান কৈলাসে স্বামী শিবের কাছে।
সনাতন ধর্মের যে কোনো পূজার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃত মন্ত্রগুলো। দুর্গাপূজার মন্ত্রগুলো সাধারণত শ্রী শ্রী চন্ডী থেকে পাঠ করা হয়। ঢাকঢোল, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, সুগন্ধি আগরবাতি আর এগুলোর সঙ্গে সংস্কৃতমন্ত্র পবিত্র এক অনিন্দ্যসুন্দর পরিবেশের জন্ম দেয়। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীর কাছে দেবী দুর্গা পরম ভক্তিময়। তার একরূপ অসুরবিনাশী, আরেকরূপ মমতাময়ী জগৎ জননী। তিনি অশুভের প্রতীক অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। ফলে, দুর্গাপূজা প্রকৃতপক্ষে আমাদের অন্যায়-অশুভের বিপরীতে ন্যায় ও শুভশক্তির জয়ের বার্তা দেয়। মা কেবল সৌন্দর্য-মমতা-সৃজনের আধারই নয়, অসহায় ও নিপীড়িতের আশ্রয় দানকারী বলেও গণ্য ও পূজিত।
বোধনের পর দেবীর অধিবাস, বেল তলায় দেবীর আরাধনা। গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্ণী, সরস্বতী- সপরিবারে একরাত সেখানেই থাকবেন মা দুর্গা। সপ্তমীর সকালে পা দেবেন বাপের বাড়িতে।
সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, কৈলাস শিখর ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা মা দুর্গার অকাল 'বোধন' ভোরের শিউলি ছড়াচ্ছে মোহনীয় গন্ধ। এমন শারদীয় আবহেই শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।
এই বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবীর নিদ্রা ভাঙার জন্য বন্দনা পূজা করা হবে। মন্ডপে, মন্দিরে ষষ্ঠীতে সায়ংকালে তথা সন্ধ্যায় এ বন্দনা পূজা অনুষ্ঠিত হবে। বোধন দুর্গাপূজার প্রধান একটি আচার। 'বোধন' শব্দের অর্থ হলো 'জাগরণ' বা চৈতন্যপ্রাপ্তি। পূজা শুরুর আগে সন্ধ্যায় বিলস্নবৃক্ষ (বেল শাখায়) দেবীর বোধন দুর্গাপূজার একটি অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। শরৎকালের দুর্গাপূজায় এই বোধন করার বিধান রয়েছে। বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে, ভগবান রামচন্দ্র শরৎকালে রাক্ষস রাজ রাবণকে বধ করার উদ্দেশ্যে দুর্গাপূজা করেন। তিনি অকালে এই বোধন করেন বলেই এটি অকাল 'বোধন' নামে খ্যাত। তবে বসন্তকালে বা চৈত্র মাসে যে দুর্গাপূজা তথা বাসন্তীপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বোধন করার প্রয়োজন হয় না।
বাংলাদেশে এ বছর দুর্গাপূজা :
কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে এ বছর ৩১ হাজার ৪ শত ৬১টি মন্ডপে পূজা হচ্ছে। গত বছর এই পূজার সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৪শত ৮টি পূজামন্ডপে।
দুর্গাপূজা উদযাপন :
শিউলি পুষ্পের শরৎ এ ইতোমধ্যে দেশজুড়ে উৎসবের ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন জামা কাপড়, নতুন জুতো, নতুন পাঞ্জাবি, পাজামা কোথাও কোথাও পুরুষরা ধূতি-পাঞ্জাবি পরে আর সনাতনী নারীরা শাড়ি পরে হৈ-হুলেস্নাড়, খাওয়া-দাওয়া, পূজামন্ডপে দল বেঁধে গিয়ে প্রসাদ নেওয়া, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব একত্রে মিলেমিশে পূজার আনন্দ উদযাপন। শরতের শুদ্ধ স্পর্শে সবার অন্তর্লোকে স্পন্দিত হয়ে উঠুক জীবনযাপনের মধুর ছন্দ।
আর দুর্গোৎসবের স্মৃতিগুলো ঝরে পড়ুক শিউলি পুষ্পের গন্ধে।
'যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা,
নমস্তৈস্যই, নমস্তৈস্যই, নমস্তৈস্যই নমো নমঃ।'
অর্থাৎ যে দেবী শক্তিরূপে সর্বজীবে বিরাজিতা তাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
মন্তোষ চক্রবর্তী : লেখক ও সাংবাদিক