মা দুর্গার আগমন
প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
তারাপদ আচার্য্য
যাকে দেখে মন উলস্নসিত হয়ে ওঠে, তাকে আবাহন করার গানই আগমনী। শুধু দেখে নয়, তাকে ভেবেই আনন্দ। স্মরণে, মননে তিনি আচ্ছন্ন করে রেখেছেন যে! তাই তো তার আসার সময় হলেই ধৈর্য আর মানে না। আকাঙ্ক্ষিত জনের আগমনে মনের মধ্যে আনন্দের উদ্বেল উচ্ছ্বাস মঞ্জুরিত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের 'পূরবী' গ্রন্থের 'আগমনী' কবিতায় এই উচ্ছ্বাসের অপূর্ব এক বাণীররূপ দেখি :
'গোপনে এলো, স্বপনে এলো, এলো সে মায়াপথে,
পায়ের ধ্বনি নাহি।
ছায়াতে এলো, কায়াতে এলো, এলো যে মনোরথে
দখিন-হাওয়া বাহি।
অশোকবনে নবীন পাতা
আকাশপানে তুলিল মাথা,
কহিল, 'এসেছ কি।'
মর্মরিয়া থরোথরো কাঁপিল আমলকী'
এই বাঙালি মানসিকতাতেই মা দুর্গা হয়ে গিয়েছেন ঘরের মেয়ে। এই তাকে দেখি সিংহাসনে, আর চোখ ফিরিয়েই দেখি বেড়ার ধারের ঘরের আটপৌরে কিশোরী মেয়ে। আর-
"মহামায়ায় যতই মানাক সিংহ এবং সিংহাসনে,
রামপ্রসাদেও বেড়ার ধারে দেখেই যে হয় হিংসা মনে।'
এই মা দুর্গা আদ্যাশক্ত, পরমাপ্রকৃতি, জগজ্জননী, অশিবনাশিনী, দনুজদলনী। দশভুজে তিনি দশপ্রহরণধারিণী।
'শ্রী শ্রীচন্ডী'তে তিনি দেবতাদের বলেছেন:
'ব্রিয়তাং ত্রিদশাঃ সর্বে যদস্মত্তোহভিবাঞ্ছিতম্।
(দদাম্যহমতিপ্রীত্যা স্তবৈরেভিঃ সুপূজিতা।।)'
- হে অমর দেবগণ, তোমাদের যা প্রার্থনীয় আমার কাছে প্রর্থনা কর; আমি তোমাদের স্তুতিতে সন্তুষ্ট; তোমাদের (্্ঈপ্সিত) বর আমি প্রদান করব।
লক্ষণীয়, বঙ্কিমচন্দ্র দেশজননীকে শুধু দুর্গ নয়, মহালক্ষ্ণী ও মহাসরস্বতী রূপেও অভবন্দনা করেছেন। শ্রী শ্রীচন্ডীতেও দেখছি মহাকালী, মহালক্ষ্ণী ও মহাসরস্বতী রূপে আরাধিতা মহাশক্তি। সেখানে দেখছি, মহাকালী দশভুজা- তার দশটি মুখ, দশটি পা আর তার গাত্রবর্ণ নীলকান্তিতুল্য প্রভাবিশিষ্ট; মহালক্ষ্ণী প্রবালপ্রভা আর তিনি অষ্টাদশভুজা; মহাসরস্বতীর আট হাত, বর্ণ তার মেঘের মধ্যকার চন্দ্রের স্নিগ্ধ প্রভার মতো। আবার দেখি মার্কন্ডেয়- পুরাণে তিনি সহস্রভুজা। এরা সব মা দুর্গারই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকাশ। 'দুর্গা' শব্দের আভিধানিক অর্থ পরমাপ্রকৃতি, শিবপত্নী।
দুর্গা রাজার শত্রম্নদের বিনাশ করেন; মানুষের দুঃখ মোচন করেন। এই দুর্গার প্রসাদে দেবতারা নিশ্চিন্ত হন, তাদের স্বর্গশাসন নিষ্কণ্টক হয়।
'শ্রীশ্রীচন্ডীতে দেওয়া দুর্গার অভয়বাণী স্মরণ করি, তবে দেখা যাবে তিনি সর্বকালেই পীড়িতের অভয়দাত্রী।
\হরবীন্দ্রনাথ আগমনী ভাবনায় নতুন যে- দর্শন এনেছেন, তাতে প্রকৃতিও সমানভাবে এসে মিশেছে। এক শরতে (৫ অক্টোবর ১৮৯৪, ছিন্নপত্র) লিখছেন তিনি : 'আজ সকালের বাতাসে ঈষৎ শীতের সঞ্চার হয়েছে, একটুখানি শিউরে ওঠার মতো। কাল দুর্গোৎসব: আজ তার সুন্দর সূচনা। ঘরে ঘরে দেশের লোকের মনে যখন একটা আনন্দ প্রবাহিত হচ্ছে তখন তাদের সঙ্গে আমর ধর্মসংস্কারের বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বে ও সে আনন্দ মনকে স্পর্শ করে।. . . দেশের ছেলে-বুড়ো সবাই হঠাৎ দিনকয়েকের জন্য ছেলেমানুষ হয়ে উঠে একটা বড়ো গোছের খেলায় লেগে গেছে। ভেবে দেখতে গেলে আনন্দের আয়োজন মাত্রই পুতুল খেলা, অর্থাৎ তাতে আনন্দ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, লাভ নেই- বাইরে থেকে দেখে মনে হয় সময় নষ্ট। কিন্তু সমস্ত দেশের লোকের মনে যাতে একটা ভাবের আন্দোলন এনে দেয় তা কি কখনো নিষ্ফল হতে পারে?. . . . দেশের সমস্ত লোক ভাবুক হতেই পারে না, কিন্তু এই রকম উৎসবের সময় ভাবস্রোত অধিকাংশ লোকের মনকে অধিকার করে। তখন যেটাকে দূরে থেকে সামান্য পুতুল বলে মনে হয়, কল্পনায় মন্ডিত হয়ে তার সে মূর্তি থাকে না।'
এক কথায় তিনি অনন্ত-অসীম; তিনি অনাদি বলে তার উৎপত্তি নেই, লয় ও ক্ষয় নেই। আবার তিনি সব কারণের কারণ। তিনি সর্বভূতে শক্তিরূপে বিদ্যমান এবং তার শক্তি ছাড়া জীব শবের মতো নিষ্ক্রিয় অর্থাৎ শক্তিহীন শিব মানে শব। জীবের চিণ্ময়ী শক্তিই তার আসল রূপ।
বাঙালির এই ভাবনার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে 'শ্রীশ্রীচন্ডী'তে পরমেশ্বরী শিবপত্নীর কাছে দেবতাদের প্রার্থনার সুমহান সুরটুকু:
'প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবি বিশ্বার্তিহারিণি।
\হত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।'
- হে বিশ্বার্তিহারিণি দেবি, আমার তোমার কাছে প্রণত, তুমি প্রসন্না; ত্রিলোকের সমস্ত অধিবাসীর কল্যাণে তুমি বরদাত্রীরূপে প্রকাশ পাও।
সব জীবের কল্যাণ কামনার এই সুরটুকুই বাঙালির আগমনীর ভাবনায় বিধৃত।
তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ