শিশুর মানসিক বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে অভিভাবক।

শিশুর মানসিক বিকাশ ও প্রাসঙ্গিক কথা

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের প্রথম বছরগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ সময়ে তার মস্তিষ্কের কোষগুলো সবচেয়ে দ্রম্নতগতি সম্পন্ন হয়ে ওঠে। শিশুর চিন্তাশক্তি, ভাষাগত দক্ষতা, আবেগের নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক দক্ষতা এই সময় তৈরি হয়। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সঠিকভাবে ঘটলে সে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে, সমস্যা সমাধানে সক্ষম হতে ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে। মানসিক বিকাশ ঠিকমতো না ঘটলে শিশুর মধ্যে হতাশা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং একাকিত্বের অনুভূতি জন্মাতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি তার পড়াশোনা, কর্মজীবন ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য যত্নবান হওয়া প্রত্যেক অভিভাবক ও শিক্ষকের কর্তব্য। শিশুর মানসিক বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে তার শারীরিক এবং মানসিক পরিচর্যা করা। শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বের দাবিদার। শিশুর সঙ্গে গভীর মানসিক সংযোগ গড়ে তোলা, তার আবেগ বুঝতে চেষ্টা করা এবং সব সময় তার পাশে থাকা প্রয়োজন। শিশুর মনের অবস্থা বুঝতে এবং তার চাহিদা পূরণ করতে অভিভাবকের ভূমিকা অপরিহার্য। প্রথম থেকেই শিশুর কাছে মানসিক স্থিতিশীলতা এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করা তার মানসিক বিকাশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। শিশুর সঙ্গে নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক তৈরি করা, তার সঙ্গে সময় কাটানো এবং তাকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা শিশুদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক হয়। শিশুর প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণের জন্য তাকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং তাকে মানসিকভাবে সুরক্ষিত অনুভব করানো অপরিহার্য। শিশুর চারপাশের পরিবেশ সরাসরি তার মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। যদি শিশুকে সুরক্ষিত, স্নেহময় এবং সমর্থনময় পরিবেশ দেওয়া হয়, তবে তার মানসিক বিকাশ দ্রম্নতগতিতে এবং সঠিকভাবে ঘটে। শিশুরা তাদের আশপাশের মানুষের কাছ থেকে শিখে, তাই পরিবারের সদস্যদের আচরণ, মনোভাব এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি শিশুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। শিশুদের জন্য পরিবেশকে আনন্দদায়ক এবং নির্ভরযোগ্য করতে হলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক থাকা উচিত। যদি শিশুর সামনে পরিবারে ঝগড়া, সংঘাত বা নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শিত হয়, তবে শিশুর মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিশুর মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং তাকে সামাজিক দক্ষতায় পারদর্শী করতে তাকে ভালোবাসার মাধ্যমে নিরাপদ এবং স্থিতিশীল পরিবেশ প্রদান করা আবশ্যক। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা শিখে কীভাবে দলগতভাবে কাজ করতে হয়, কীভাবে নিয়ম মানতে হয় ও কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সমাধান খুঁজে পেতে হয়। শারীরিক খেলা শিশুর শরীরকে সুস্থ রাখে, কিন্তু মানসিক খেলা তার সৃজনশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তার বিকাশে সহায়ক। শিশুর মানসিক বিকাশে ভাষা ও যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষার মাধ্যমে শিশুরা তাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং আবেগ প্রকাশ করে। সঠিক ভাষাগত দক্ষতা শিশুর সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে এবং তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তাই শিশুর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, গল্প শোনা বা বলা এবং তাকে নতুন শব্দ শেখানো তার ভাষাগত বিকাশে সহায়ক হয়। শিশুকে প্রতিদিন বই পড়ার অভ্যাস করানো এবং গল্প শোনানো তার চিন্তাশক্তি এবং কল্পনাশক্তি বাড়ায়। তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা এবং তাকে নিজের মনের কথা প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে শিশুর ভাষাগত দক্ষতা বাড়ে এবং সে আরও স্পষ্টভাবে ও স্বচ্ছন্দে তার মতামত প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। শিশুর মানসিক বিকাশে সৃজনশীলতার গুরুত্ব অত্যধিক। সঙ্গীত, নাচ, চিত্রাঙ্কন, লেখালেখি এবং নাটক শিশুর সৃজনশীল বিকাশে সহায়ক। সৃজনশীল কর্মকান্ড শিশুর কল্পনাশক্তি বাড়িয়ে তোলে এবং তার মনোযোগ ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। শিশুকে তার পছন্দমতো সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত করতে দিলে সে তার আবেগ প্রকাশ করতে পারে এবং নিজের মনের অনুভূতিগুলো বুঝতে পারে। শিশুর মানসিক বিকাশে সামাজিক দক্ষতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুকে শেখানো উচিত কীভাবে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় এবং কীভাবে একটি দলে কাজ করতে হয়। সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিশুরা অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখে এবং একে অপরের প্রতি সমর্থন প্রদান করতে পারে। শিশুকে সমাজের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো, পারিবারিক উৎসবে তাকে নিয়ে যাওয়া এবং বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে দেওয়া তার সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সে ভবিষ্যতে সফল সমাজবদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ইতিবাচক শৃঙ্খলা শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক হয় এবং তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। শিশুকে নিয়মিত দায়িত্ব দেওয়া, তার সাফল্যের প্রশংসা করা এবং তাকে তার ভুল শুধরে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। এর মাধ্যমে সে দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রযুক্তির প্রভাব বর্তমান যুগে শিশুদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর ব্যবহারে সংযম বজায় রাখা প্রয়োজন। আধুনিক প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারে শিশুর মানসিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। শিশুরা যদি দীর্ঘসময় টেলিভিশন, মোবাইল বা কম্পিউটারের পর্দার সামনে সময় কাটায়, তবে তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে যদি তারা সহিংস বা অশোভন কনটেন্ট দেখে, তাহলে তাদের চিন্তাধারা এবং আবেগপ্রবণতা নষ্ট হতে পারে। শিশুরা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো থেকে দূরে সরে যায় এবং ভার্চুয়াল জগতে আটকে পড়ে- যা তাদের মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। তাই, শিশুর প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সময় বেঁধে দিতে হবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং মানসিক বিকাশে সহায়ক শিক্ষামূলক কনটেন্ট বেছে নেওয়া উচিত। শিশুকে অবশ্যই খেলাধুলা, পড়াশোনা এবং সামাজিক কার্যক্রমে উৎসাহিত করা উচিত, যাতে ভার্চুয়াল জগতের প্রতি তার আসক্তি না বাড়ে। শিশুরাও অনেক সময় মানসিক চাপে পড়তে পারে, বিশেষ করে যদি তারা স্কুলের পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক সমস্যার প্রভাব বা বন্ধুদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া থেকে হতাশা অনুভব করে। শিশুরা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাদের মনের মধ্যে সংকট তৈরি হয়- যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করে। শিশুর মানসিক চাপ কমাতে তাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। যদি শিশুর আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা যায়, তবে তা মানসিক চাপের ইঙ্গিত হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তার পাশে থাকতে হবে, তার চিন্তাভাবনা শোনা এবং তাকে তার আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। মানসিক চাপ কমানোর বিভিন্ন কৌশল যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, মেডিটেশন, অথবা সৃজনশীল কাজে নিযুক্ত করা শিশুকে মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে সাহায্য করতে পারে। শিশুর মানসিক বিকাশে তার স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুকে স্বাধীন চিন্তা এবং সৃষ্টিশীলতার সুযোগ দেওয়া মানসিক বিকাশের জন্য সহায়ক। শিশুর নিজের মতামত এবং ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে তার ওপর চাপ না দেওয়া উচিত। এতে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং নিজেকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে শেখে। শিশুকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া এবং তার মতামতকে শ্রদ্ধা করা অভিভাবকদের দায়িত্ব। অভিভাবকরা শিশুর ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি না করে তাকে নিজের পথে চিন্তা করার সুযোগ দিলে সে সৃজনশীল এবং সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। শিশুকে স্বাধীনতা দিলে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সে ভবিষ্যতে আরও সাহসী এবং দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। শিশুর মানসিক বিকাশে ইতিবাচক মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর প্রতি অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের মানুষের মনোভাব তার মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। যদি শিশুর প্রতি সমর্থনময় এবং ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করা হয়, তবে সে নিজেকে নিরাপদ ও মূল্যবান অনুভব করে। এটি তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তাকে সফলতার দিকে ধাবিত করে। শিশুর মানসিক বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে অভিভাবক। অভিভাবকের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিক সহায়তা সরাসরি শিশুর মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। শিশুর জীবনের প্রতিটি ধাপে অভিভাবকের সমর্থন, নির্দেশনা এবং ভালোবাসা তার মানসিক স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। অভিভাবককে শিশুর প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে এবং তাকে সহানুভূতি ও সমর্থন দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। শিশুর ভুলত্রম্নটি বুঝতে পারা, তাকে তার মতামত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া এবং তার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া অভিভাবকের প্রধান দায়িত্ব। শিশুর মানসিক বিকাশে সফলতার জন্য অভিভাবকের ইতিবাচক মনোভাব এবং সঠিক নির্দেশনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক, লেখক