পঙ্গুত্ব মৃতু্যর চেয়ে বিভীষিকাময়

রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে নিহত-আহত সব নাগরিকের পাশে। তার জন্য তাদের সঠিক সংখ্যা এবং বর্তমানে কে কী অবস্থায় আছেন - তা নিরূপণ করা খুব জরুরি।

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মোস্তফা আবু রায়হান
গণহত্যা ও গণ-অভু্যত্থানের রাতগুলোতে ঘুমাতে পারিনি। এমনকি ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম আসেনি। আবদুল আহাদ আটতলার বারান্দায় বাবা-মায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকে যেভাবে গুলি খেয়ে মরল। কিংবা রিয়া গোপ চারতলার ছাদে খেলতে খেলতে যেভাবে বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুনিয়া ছাড়ল। আমার বিশ্বাস, দেশের ওই বাস্তবতায় কোনো সুস্থ মানুষেরই ঘুম আসার কথা নয়। তারপর গণ-অভু্যত্থান সফল হয়েছে। দেশ আজ 'মুক্ত'। রাষ্ট্রীয় গণহত্যা ও গোলাগুলি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু আজও রাতের পর রাত ঘুম আসে না। হাসপাতালে-ক্লিনিকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃতুুর অপেক্ষায় প্রহর গোনা; কল্পনায় নিয়তির বীভৎস মুখ নিরীক্ষণ করতে থাকা আহত-পঙ্গু ছাত্র-জনতার ছিন্নভিন্ন ছবি ভেসে আসে বারবার চোখের সামনে। গণঅভু্যত্থান সৃষ্টি করেন গণ-মানুষ। এমন বিপরীতমুখী নাগরিকরা সেখানে জোট বাঁধেন, বাস্তবে যাদের কোনো দিন পাশাপাশি হাঁটা তেমন একটা হয়নি। সেখানে অপরিচিত নারী-পুরুষ একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রুখে দাঁড়াতে মরিয়া হন। সেখানে শিক্ষিত-মূর্খ হাত ধরাধরি করে মিছিল করেন। সেখানে আস্তিক-নাস্তিক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এভাবেই গণ-অভু্যত্থানন সফল হয়, অশুভ শক্তির পতন হয়। কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর চোখ ঝলসানো বিজয়ের আলোয় দিগন্তপস্নাবী বিজয়মিছিল চলে সম্মুখপানে। ক্রমে পেছনে পড়ে যেতে থাকেন অগণন শহীদেরা। মৃতু্যর চেয়ে ভয়ংকর বিভীষিকাময় অন্ধকারে আবদ্ধ হয়ে পড়েন, মৃতু্যর সুযোগ হয়নি এমন আহত বিপস্নবীরা। বিজয়ের 'আলো' কিংবা 'আনন্দ' কতখানি ছুঁতে পারে তাদের! ৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ বিজয় মিছিলে আমরা যারা চলেছি উত্তেজনার উত্তুঙ্গে সওয়ার হয়ে; হয়ত আমাদের অধিকাংশেরই যায়নি কিছুই, হারায়নি কিছুই। কিন্তু যাদের গিয়েছে জীবন, নাম জানা, নাম না-জানা; শুয়ে আছেন যারা অজ্ঞাত হয়ে জ্ঞাত-অজ্ঞাত গণকবরে। যে কিশোর একটি হাত হারিয়েছেন, যে তরুণ একটি পা হারিয়েছেন, যে বালক হারিয়েছেন একটি চোখ। যাদের শরীর থেকে অঝোর ধারায় ঝরে গেছে রক্ত। যে শিশু, যে যুবক শরীরে বহন করছেন আমৃতু্য অমোচনীয় জখম, অপূরণীয় ক্ষত এবং ক্ষতি। যারা আজও পড়ে আছেন অনিশ্চয়তায়, জীবন-মৃতু্যর সন্ধিক্ষণে। তাদের কথা কি আমরা ভুলতে বসেছি? আমরা ভেবেছি কি? যার দুই হাত নেই, তিনি কী করে আজ বহন করে নিয়ে যাবেন বিজয়ের পতাকা? যিনি দুই পা হারিয়েছেন, তিনি কি শামিল হতে পারবেন বিজয়ের মিছিলে? দুচোখ হারিয়েছে যারা আজ অন্ধ, তাদের কি দেখা হবে বিজয়ের সূর্য? তাদের কি কোনোভাবে বোঝানো যাবে, বিজয়ের আলো দেখতে কেমন হয়? তাদের চোখের মধ্য দিয়ে মগজের গহিন কোষে কোনো দিন তো পৌঁছাবে না এক কণা বিজয়ের বর্ণিল আলো। যে মা-বাবা সন্তান হারালেন তারা কি কোনো দিন অনুভব করতে পারবেন, কেমন হয় বিজয়ের আনন্দ? যে স্ত্রী স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে আজ অকূল পাথারে, তার কাছে বিজয়ের সংজ্ঞা কেমন, তা ভাবার দুঃসাহস কারও আছে কি? ভাইয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল ফুরিয়ে ফেলেছে যে বোন; অথবা বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে, বাবা ঘুম থেকে উঠবে বলে অপেক্ষায় আছে যে দুধের শিশু, আমার সাহস নেই তাদের সামনে 'স্বাধীনতা' বা 'মুক্তি' শব্দটি উচ্চারণ করার। অনেক পরিবারই আজ মৃতপ্রায় আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। অভিযোগ আছে, দেশের অনেকস্থানেই সরকারি বা বেসরকারিভাবে কেউই আজ পর্যন্ত চিকিৎসা-সহায়তা নিয়ে দাঁড়ায়নি আহত-পঙ্গু ছাত্রজনতার পাশে। গণমাধ্যম-সূত্রে জানা গেল, দিনাজপুরে গুলিবিদ্ধ স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সদ্যোজাত তিন দিনের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন এক নারী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে এবং যারা পড়ে আছেন অলক্ষ্যে, তাদের মর্মান্তিক দুরবস্থা আজ নতুন বাংলাদেশের মানুষকে ছুঁতে পারছে কিনা জানি না। মাথার ভেতর, বুকের ভেতর একাধিক গুলি বরণ করে আজ কথা বলার ক্ষমতা হারানো আহত বিধ্বস্ত মানুষকে আশাহীন নির্বাক তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ছিন্নভিন্ন মগজে তাদের যদি ভাবনার ক্ষমতা এখনো অবশিষ্ট থেকে থাকে তারা হয় ত ভাবছেন, তাদের কেন মৃতু্য হলো না। এরকম অবস্থায় তো তারা বেঁচে থাকতে চাননি। অন্তর্বর্তী সরকার 'দেশ-সংস্কার' করবে, সারাদেশ আশায় বুক বেঁধে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও দেশের মানুষ যার যার জায়গা থেকে নিজেকে সংস্কার না করতে পারলে 'দেশ-সংস্কার' একটি অসম্ভব এবং অবাস্তব ব্যাপার। কিন্তু 'দেশ-সংস্কার' করতে যাওয়ার আগে তাদের ব্যাপারে ভাবতে হবে, যারা 'দেশ-সংস্কারের' সুযোগ এনে দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে- নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজও সেটি সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তাই বলব, শহীদদের অনন্য মহিমার কাছে মুমূর্ষু আহতদের আর্তনাদ যেন গুরুত্বহীন এবং শ্রবণাতীত হয়ে না পড়ে। শহীদদের পরিবারকে সম্মাননা জানানোর আগে মৃতু্যর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া ছিন্নভিন্ন এই মানুষগুলোর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা অধিক জরুরি। রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে নিহত-আহত সব নাগরিকের পাশে। তার জন্য তাদের সঠিক সংখ্যা এবং বর্তমানে কে কী অবস্থায় আছেন - তা নিরূপণ করা খুব জরুরি। মৃতদের এবং আহতদের পরিবারগুলো ভয়ঙ্কর এই ক্ষত বহন করে চলার পথে আর যেন নতুন বঞ্চনার হাহাকার প্রকাশ না করেন। তাদের জন্য নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বা সাময়িক এককালীন সহায়তা করে যেন দায় সারা না হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জন্য যেন সম্মানজনক, ন্যায়ানুগ এবং স্থায়ী পুনর্বাসন-ব্যবস্থা করা যায়। শহীদদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পরিবারগুলোকে যেন আর্থিকভাবে স্থায়ী-পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়। যারা গণহত্যার স্থায়ী জখম নিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে বেঁচে থাকতে বাধ্য হবেন, মৃতু্য পর্যন্ত রাষ্ট্র যেন তাদের দায়িত্ব নেয়। নানান সংস্কারের ডামাডোলে তাদের বিষয়টি যেন চাপা পড়ে না যায়, এড়িয়ে যাওয়া না হয়। মৃতু্যর চেয়ে বিভীষিকাময় যে পঙ্গুত্ব, তার ভয়ানক লোমহর্ষক অন্ধকারেও তারা বাঁচার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহ করা একটু আলো যেন পায়। মোস্তফা আবু রায়হান : কবি ও সংস্কৃতিকর্মী