বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য দরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন

দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য ঠিক রাখতে যেমন পরিবেশের ওপর সবার অধিক যত্নশীল হওয়া দরকার, একইভাবে দেশের পরিবেশগত উন্নয়ন প্রয়োজন।
হাসিবুল হাসান হিমেল
  ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য দরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন

এই আলো ঝলমলে স্বচ্ছ আকাশ, আবার এই সারা আকাশ ঘনিয়ে মেঘ করে ঝুম বৃষ্টি। এ যেন ঠিক রূপকথার দেশ। এই নীল আকাশে পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা, তো পরক্ষণেই গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। অক্টোবর এলেই বাংলার প্রকৃতিতে এই রূপরেখা দেখা যায়। যদিও ঋতুটা শরৎকাল, তবে এই শরৎকালেও বাংলার প্রকৃতিতে অন্যান্য ঋতুর বিভিন্ন রূপরেখা ফুটে ওঠে। সকালে ঘুম ভাঙে খোলা জানালা দিয়ে শুভ্র মেঘদলের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে। যেন একগুচ্ছ সাদা কাশফুল হাতে নিয়ে শরৎ এসে হাজির হয়েছে দুয়ারে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে না হতেই রৌদ্রের তীব্রতায় হাঁসফাঁস করতে থাকে জনজীবন। ক্লান্ত পথিক যেন চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে কখন গ্রীষ্মের দাবদাহের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে আগমন ঘটবে স্নিগ্ধ বর্ষার। যেন সে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করছে শ্রাবণের শীতল ধারা দিয়ে গ্রীষ্মের তীব্রতাকে ম্স্নান করে দিতে। ঠিক সেই মুহূর্তে সারা আকাশে মেঘ ঘনিয়ে বর্ষার নব-বারিধারার মতো অক্টোবর রেইনের স্পর্শে শীতল হয় জনজীবন। কখনো কখনো একনাগাড়ে দিন-রাত টানা বৃষ্টি নামতে থাকে। তখন চারিদিকে শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। যেন শরতের অনুপস্থিতিতে স্বয়ং শীতকাল এসে প্রক্সি দিচ্ছে। এই এক শরতেই দেখা মেলে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষার। যেন চারটি ঋতু মিলে শরতের এক মধুর সংমিশ্রণ। শরতের এই শৈল্পিক রূপরেখা ফুটিয়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে অক্টোবর রেইন অর্থাৎ অক্টোবর মাসের বৃষ্টি। কেননা, অক্টোবর মাস শেষ হলে বাংলার আকাশে বর্ষার আনাগোনা তেমন একটা চোখে পড়ে না বললেই চলে। এই অক্টোবর মাসটা রসিক বাঙালিদের জন্য যেন সোনায় সোহাগা। সকালে মেঘেদের সঙ্গে কথপোকথনের মাধ্যমে দিন শুরু। কয়েকদিন টানা বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট হিমেল আবহাওয়ায় কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে লম্বা ঘুম ও ভূরিভোজ। বিকালে কাশবনের মায়ায় হারিয়ে যাওয়া কিংবা রাতে আশ্বিনের মাধুর্য মেশানো পূর্ণ চন্দ্রের রুপালি জোছনায় গা ভেজানো। এক অক্টোবর যেন প্রকৃতিপ্রেমী রসিক বাঙালিদের জন্য অপরূপ সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে বাংলার মাটিতে পদার্পণ করে। যেন সত্যিকার অর্থে রূপকথার জগতে বসবাস। যেন সমস্ত কল্পনারা এসে বাস্তবে ধরা দিয়েছে।

কিন্তু আসলেই কি অক্টোবরের বাস্তব চিত্র এমন? আসলেই কি বাংলার প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ সারা অক্টোবর জুড়ে রূপকথার জগতে বসবাস করে! গুটিকয়েক আভিজাত্য সম্প্রদায়ের জন্য শরৎ বা অক্টোবর মাসটা রূপকথার জগতের মতো মনে হলেও নিম্ন-মধ্য আয়ের এই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য অক্টোবর মাসটা ততটা আশীর্বাদস্বরূপ না। বাস্তব চিত্র অনেকটা ভিন্ন। নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে নিত্যদিনের কাজকর্ম বাদ দিয়ে বিলাসবহুল ও রসিক জীবনযাপন করা এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য শুধু অসাধ্যই নয় অসম্ভবও বটে। সকাল হতে না হতেই রুটি-রুজির তাগিদে কর্মক্ষেত্রে ছুটতে হয় এ দেশের অধিকাংশ মানুষকে। সময় কোথায় সকালে শরতের একগুচ্ছ সাদা মেঘের সঙ্গে কথপোকথনের মাধ্যমে ঘুম ভাঙার? কর্মক্ষেত্রে সময়মতো পৌঁছানোর জন্য আবার যুদ্ধ করতে হয় অপ্রতিরোধ্য যানজটের সঙ্গে। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পকারখানা এবং ব্যবসাবাণিজ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু যেহেতু ঢাকা- তাই কর্মের তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর মানুষকে ঢাকায় পাড়ি জমাতে হয়। যার ফলে, দেশের অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর থেকে ঢাকার জনসংখ্যা এবং যানবাহনের সংখ্যা অধিক হারে বেশি। এই মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং যানবাহনের ফলে প্রতিদিনই ঢাকার মানুষকে যুদ্ধ করতে হয় যানজটের সঙ্গে। আর এই যানজটের সঙ্গে যদি যুক্ত হয় কয়েকঘণ্টার টানা বৃষ্টিপাত তাহলে তো কথাই নেই। ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার এতটাই বেহাল দশা যে মাত্র কয়েকঘণ্টার টানা বৃষ্টিপাতেই ঢাকা শহরের অধিকাংশ রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে করে যানবাহনগুলোই স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না। সুতরাং, সাধারণ পথচারীদের চলাচলের অসুবিধার কথা আলাদা করে বলার আর প্রয়োজন পড়ে না। ঢাকার এই অতিরিক্ত মাত্রায় জলাবদ্ধতার জন্য ব্যাপক হারে দায়ী ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর প্রাণহীনতা এবং পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেনগুলোকে ময়লা-আবর্জনা ও পস্নাস্টিকের স্তূপ দিয়ে ঢেকে অচল করে দেয়া। এই অচল ড্রেনগুলোর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল করলেও অনেক সময় যথাযথ ফল পাওয়া যায় না। কেননা, এই ড্রেনের মাধ্যমে পানি যে নদীতে গিয়ে পড়বে সেই নদীগুলোর বেশিরভাগই আজকাল মৃতপ্রায়। অনেক নদী ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে কলকারখানা এবং যেটুকুও বা অবশিষ্ট আছে সেগুলোকে ঠিকমতো করা হচ্ছে না রক্ষণাবেক্ষণ। যার ফলস্বরূপ ঢাকার রাস্তার পানি যথাযথভাবে নিষ্কাশিত না হয়ে সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা এবং জনজীবনকে করে তুলছে অতিষ্ঠ।

এভাবে সারাদিন প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে প্রায় যন্ত্র-মানবে রূপান্তরিত হওয়া একজন মানুষের পক্ষে কি আদৌও আশ্বিনের জোছনা-মাখা রজনী উপভোগ করা সম্ভব? সারাদিনের এত ধকলের পর একজন মানুষের মানসিক অবস্থা এতটাই অবসাদগ্রস্ত থাকে যে, রাতের জোছনা-মাখা রুপালি চাঁদটাকেও তার অসহ্য মনে হয় এবং তা হওয়াটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। আর সারাদিনের এসব প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে গেলে শুধু শরৎ বা অক্টোবর কেন, কোনো ঋতুর সৌন্দর্যই সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করা সম্ভব নয়।

\হদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য ঠিক রাখতে যেমন পরিবেশের ওপর সবার অধিক যত্নশীল হওয়া দরকার, একইভাবে দেশের পরিবেশগত উন্নয়ন প্রয়োজন।

তেমনি সেই পরিবেশে সুস্থ সুন্দরভাবে জীবনযাপন করা ও পরিবেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলোকে মনেপ্রাণে উপভোগ করার জন্য দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিরসন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নও জরুরি। তাই পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলো উপভোগ করার জন্য দেশের মানুষকে মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রস্তুত করতে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনেও আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

হাসিবুল হাসান হিমেল : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে