বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। রোগের স্বাভাবিক লক্ষণ উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা,র্ যাশ ওঠা, চোখ লাল হওয়া ব্যতিরেকে হঠাৎ জ্বরে ভুগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা যায়। স্ত্রী এডিস মশা জল থাকা পাত্রের ভেতরের দিকের ভেজা দেয়ালের গায়ে ডিম পাড়ে, এবং বৃষ্টি বা অন্য কোনো উৎসের মাধ্যমে ডিমের ওপর জলের মিশ্রণ হলে, প্রায় ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে তা থেকে লার্ভাগুলো বেরিয়ে আসে। ৪ দিনের মধ্যে সেই লার্ভাগুলো মাইক্রো-অরগ্যানিজ্?ম ও ক্ষুদ্র জৈব পদার্থগুলো খাওয়া শুরু করে এবং লার্ভা থেকে পিউপা'তে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পিউপা'র খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। ওগুলো মাত্র দু'দিনের মধ্যেই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে সংক্রমণ উপযোগী হয়ে ওঠে। তারপর সেই নতুন গঠিত মশা, পিউপা'র খোলস ভেঙে জল থেকে বেরিয়ে আসে। এডিস মশার সমগ্র জীবন চক্র দেড় থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়ে থাকে।
মূলত স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। ডিম থেকে জন্ম নেওয়া নতুন মশা কাউকে কামড়ালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। ঢাকার সবগুলো হাসপাতালে ডেঙ্গু সেল খোলা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ডেঙ্গুর রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীর মৃতু্যর খবর সবাইকে বিচলিত করে। মশার রাজত্বে মানুষ অসহায় বোধ করছে। দিনের বেলা মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, স্বচ্ছ জল জমে এমন স্থান পরিষ্কার রাখা, এসব হলো মশকমুক্ত রাখার স্বাভাবিক শর্ত। নগরে সবুজ গাছপালা কমে গেছে। মশকমুক্ত রাখার জন্য ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায় না। আবাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য যত্রতত্র গর্ত খোঁড়ার কাজ চলে। এসব জায়গা মশার বিচরণ ক্ষেত্র। টব, এসি, ফ্রিজের পানি জমে থাকা স্থানে মশা তার বংশ বিস্তার করছে। খোলা বাজারে খাবারের বিক্রি থেকে শুরু করে খোলা আকাশের নিচে যত্রতত্র মানুষ বাস করছে। মশার সঙ্গে দুই সিটি করপোরেশন নিয়ম করে মশা মারার নিত্যনতুন উদ্যোগ না থাকায় মশাসহ নানা রোগ বিস্তার অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে মানুষ অসহায় দিন যাপন করছে। খাবারে ভেজাল, নিত্যনতুন ফরমালিন ও ওষুধে খাবার পাকানো হয়। কলা, ফল, মাছ এবং সবজিতে মেশানো বিষাক্ত দ্রব্যাদি মানুষ খাচ্ছে। টাইফয়েড, জন্ডিস, বসন্ত (পক্স), চোখের অসুখ, মাথাধরা, জ্বরসহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। হাসপাতালগুলোতে ব্যবসা বন্ধ হয়নি। রকমারি পরীক্ষা রক্তের ও বিভিন্ন রোগের চলছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে ডেঙ্গু রোগের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের ওপর। এখন কমতে শুরু করেছে। উৎকণ্ঠা কমেনি। দিন আনে দিন খায় এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে বেশি। শহরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সঙ্গতি অনেকের নেই। ঢাকা শুধু নয়, জেলা শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা বেড়েছিল এবং বাড়ছে। সচেতনতা ও প্রতিরোধ কর্মসূচি মহামারি আকার ধারণের আগে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে এসেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। নতুন রোগী রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন হাসপাতালের চিত্র ভয়াবহ। সাধারণ রোগীরা মশারি টাঙিয়ে ঘুমাচ্ছেন। সাধারণত, বাঙালিরা মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে অভ্যস্ত নন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেয়া মশা সুস্থ মানুষকে কামড় দিলে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার হতে পারে। সে কারণে বাড়িতে ও হাসপাতালে দিনের বেলা মশারি টানানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ডেঙ্গুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো স্বীকৃত টিকা বা ভ্যাকসিন নেই। সুতরাং, প্রতিরোধ নির্ভর করে জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ এবং তার কামড় থেকে সুরক্ষার ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঁচটি মৌলিক দিশাসমেত সংবদ্ধ একমুখী নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সুপারিশ করেছে: (১) প্রচার, সামাজিক সক্রিয়তা, এবং জনস্বাস্থ্য সংগঠন ও সমুদায়সমূহকে শক্তিশালী করতে আইন প্রণয়ন, (২) স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিভাগসমূহের মধ্যে সহযোগিতা (সরকারি ও বেসরকারি), (৩) সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহার করে রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস, (৪) যে কোনো হস্তক্ষেপ যাতে সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে হয় তা সুনিশ্চিত করতে প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং (৫) স্থানীয় অবস্থায় পর্যাপ্ত সাড়া পেতে সক্ষমতা বৃদ্ধি।
এই মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাথমিক পদ্ধতি হলো এর বৃদ্ধির পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা। জলের আধার খালি করে অথবা কীটনাশক প্রয়োগ করে অথবা এসব জায়গায় বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল এজেন্টপ্রয়োগ। স্বাস্থ্যের ওপর কীটনাশকের কুপ্রভাব এবং কন্ট্রোল এজেন্টের ব্যয়বহুলতার কথা মাথায় রেখে পরিবেশ শোধনের মাধ্যমে জমা জল না রাখাটাই নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভালো উপায়। মানুষ পুরো শরীর ঢাকা পোশাক পরে, বিশ্রামের সময় মশারি ব্যবহার করে এবং/বা কীট প্রতিরোধক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মশার সংক্রমণ দূর করা সম্ভব।
পানির বোতল, ডাবের খোসা, টব ও বিভিন্ন কন্টেনারে পানি জমতে দেয়া যাবে না। বৃষ্টির মৌসুমে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। মশার অবাধ প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। সিটি করপোরেশন মশক নিধনে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারে।
এডিস মশা সকালে ও সন্ধ্যার পূর্বে কামড়ায়। এ সময় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। মশারি টানাতে হবে। শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরতে হবে। অন্তত সপ্তাহে একদিন বাসাবাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। ট্যায়ার, ফুলের টব, পানির বোতল, ফ্রিজ এসির পানি জমে থাকা স্থানেও খেলার মাঠ ও ভবন পরিষ্কার রাখতে হবে। ডেঙ্গুরোগ মহামারি রূপ নেওয়ার আগে বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ক্লাব, সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে। যাদের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে যত্রতত্র মশার প্রজনন বাড়ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জানা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইতোমধ্যে হানা দিয়েছে।
রোগ প্রাদুর্ভাবে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশের সব নাগরিককে। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ জোরালো করতে না পারলে নাগরিক অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সর্বোপরি সাধারণ জ্বর মনে করায় অবহেলা করে অনেক ডেঙ্গু রোগী বিলম্বে চিকিৎসকের কাছে সেবা নিতে যায়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর পস্নাটিলেট কমতে শুরু করে, তাতে নানা সংকট সৃষ্টি হয়।
সাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক