পাহাড়ে সহিংসতা :অপতথ্যের অবাধ প্রবাহ

অপতথ্যের গুজব প্রতিরোধ করা না গেলে, তা শুধু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্যও এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অঞ্চল বহুদিন ধরে সংঘাত এবং উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলে জাতিগত বৈষম্য, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রায়ই দেখা দেয়, যা রাজনৈতিক অনুঘটক হয়ে দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করে। সম্প্রতি ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর দুটি পৃথক সহিংসতায় পাঁচজন নিহত হন, যার মধ্যে একজন বাঙালি যুবকও ছিলেন। এই সহিংসতার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভুয়া এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অপতথ্যের এই ভয়াবহ বিস্তার পরিস্থিতিকে এতটাই উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলে যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে মানুষকে আতঙ্কিত করে ফেলে। তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্যগুলো সামনে আসে। ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরের দিন, ১৯ সেপ্টেম্বর, বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে এবং দীঘিনালায় ধনঞ্জয় চাকমা নামের একজন পাহাড়ি ব্যক্তি প্রাণ হারান। একই দিনে দিবাগত রাতে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, যেখানে তিনজন পাহাড়ি যুবক নিহত হন। এই ঘটনাগুলো পাহাড়ে সহিংসতার চিরাচরিত প্রবণতা। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব ঘটনার প্রকৃত তথ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভুয়া এবং ভিত্তিহীন খবরও দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে। ডিসমিসল্যাবের রিপোর্ট অনুসারে, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির এই সহিংসতা নিয়ে ফেসবুক, এক্স (পূর্বে টুইটার নামে পরিচিত) এবং ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে। এ ধরনের পেজ ও চ্যানেলগুলোতে নিহতের সংখ্যা পাঁচজনের পরিবর্তে ১০০ জনেরও বেশি বলে দাবি করা হয়েছে। 'জুম্ম' নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে মাত্র আড়াই ঘণ্টার মধ্যে বলা হয়, খাগড়াছড়িতে ইতোমধ্যেই ৩২ জন নিহত হয়েছেন। বিদেশ থেকে পরিচালিত কিছু পেজে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৩৫ জন পাহাড়ি হত্যার দাবি করা হয়, যদিও সেখানে কোনো তথ্য প্রমাণ ছিল না। এ ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এর প্রভাব ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু অনলাইন পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইলেও দেখা যায়। ভারতের কিছু সংগঠন, বিশেষ করে বিজেপির আঞ্চলিক নেতারা, এই ভুয়া তথ্যকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি না থাকলেও, দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এবং বিরোধ সৃষ্টি করে, যা পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই গুজব বা অপতথ্যের বিস্তার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ উসকে দিয়েছে। গুজবের এই সমস্যা বর্তমান সময়ের একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ, যেখানে প্রযুক্তির মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য খুব দ্রম্নত এবং বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক এই সহিংসতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষ গুজবে বিশ্বাস করে আতঙ্কগ্রস্ত হয় এবং পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে তা উল্টো খারাপ হয়ে যায়। এমনকি অনেক মানুষ এই ভুয়া তথ্যকে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যও ব্যবহার করেছে, যা আরও বেশি উদ্বেগের কারণ। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিছু ফেসবুক পেজ, যেমন 'হিল বস্নাড' ও 'বাবা বেনারস', এবং এক্স হ্যান্ডল থেকেও ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের সময় বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের সংঘর্ষের মিথ্যা পরিসংখান তুলে ধরা হয়। এমনকি ত্রিপুরার সুপরিচিত গণমাধ্যমগুলোও ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন সহিংসতা এবং তার পরবর্তী গুজবের বিস্তার পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এতে করে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাস আরও প্রকট হয়ে উঠেছে, যা দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত এবং বিভেদের ভিত্তি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। অপতথ্যের অবাধ প্রবাহ প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে সঠিক তথ্য প্রচার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের উচিত তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো রোধে কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক ও জরুরি। ফেসবুক, এক্স এবং ইউটিউবের মতো পস্ন্যাটফর্মগুলোর উচিত ভুয়া তথ্য ছড়ানো আইডিগুলো নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। একইসঙ্গে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটানো দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনার ন্যায়বিচার না হওয়া মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি সহিংস ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা দরকার, যাতে সহিংসতার ঘটনা ঘটলে দ্রম্নততার সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে, স্থানীয় জনগণের স্বার্থ রক্ষায় প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অপতথ্য ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে আরও সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অপতথ্যের গুজব প্রতিরোধ করা না গেলে, তা শুধু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্যও এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। অপতথ্য, বিভ্রান্তি এবং গুজবের অবাধ প্রবাহ রোধ করতে প্রয়োজন গণসচেতনতা, সঠিক তথ্যের প্রচার এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার সহিংসতার মূলে থাকা সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান। আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও লেখক