সরকারি হাসপাতালের করুণ দশা
শুধু জরাজীর্ণ টয়লেট ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহ উন্নত চিকিৎসাসেবা দিয়েও যে মারাত্মক ইমেজ সংকটে আছে, সে বিষয়টি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
আপনি কি কখনো দেশের কোনো সরকারি হাসপাতালে রোগী হিসেবে গেছেন? আউটডোরে? কিংবা ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে? নিদেনপক্ষে একজন ভিজিটর হিসেবে ওখানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আপনার হয়ে থাকবে। একজন রোগী হিসেবে যদি আপনি কোনো সরকারি হাসপাতালে জেনারেল বেডে ভর্তি হয়ে থাকেন কিংবা তার এটেনডেন্ট হিসেবে ওখানে অবস্থান করেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে ওখানকার টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে, কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যতিক্রম বাদ দিলে আপনার খুব কষ্টকর একটি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
দেশের বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের চিকিৎসার জন্য শেষ আশ্রয় এই সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতাল/ ক্লিনিকগুলোর বিপুল ব্যয়ের তুলনায় সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা সেবা এক রকম ফ্রি থাকা-খাওয়ার জন্যও আপনার তেমন কোনো খরচ লাগছে না। তবে, আপনাকে হয়তো হাসপাতাল জোগান দিতে না পারলে বাহির থেকে ওষুধ কেনা লাগতে পারে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও চার্জ দিতে হতে পারে, তবে তা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তুলনায় অনেক কম। এছাড়া, আপনি যদি দেশের কোনো বড় হাসপাতালে ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে ভর্তি হয়ে থাকেন, তাহলে দেশের সেরা ডাক্তারদের সেবা পাচ্ছেন। তারা প্রতিদিন এক থেকে দু'বার রাউন্ডে এসে আপনাকে দেখে যাবেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ওরাই কিংবা তাদের সমকক্ষ পর্যায়ের কেউ হয়তো আপনার চিকিৎসা প্রদান করতেন। তবে হঁ্যা, এটা ঠিক যে, বেসরকারি হাসপাতালসমূহের মতো আপনার নিজস্ব পছন্দের কোনো চিকিৎসককে ওখানে আপনি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পাবেন না।
এত কিছুর পরেও, যদি না আপনি কোনো কেবিন বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, বরং একজন ইন-প্যাশেন্ট হিসেবে জেনারেল বেডে আপনার স্থান হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আপনার মনে হবে, কবে আলস্নাহ এখান থেকে আপনাকে বের করে নিয়ে যাবেন। আপনার দেখাশোনার জন্য যদি কেউ সঙ্গে থাকেন তারও একই অনুভূতি হবে। কিন্তু কেন? না, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কোনো অব্যবস্থাপনা বা ঘাটতির জন্য নয়। স্রেফ টয়লেটসমূহের করুণ অবস্থার জন্য। আপনি টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে হয়তো দেখবেন, দুর্গন্ধের জন্য ঢোকাই যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে, টয়লেট ব্যবহার করার পর যে ফ্লাশ করবেন সেই জো নেই। সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কোথাও হয়তো দেখবেন, টয়লেটের ফ্লোরে নোংরা পানি জমে আছে। কোথাও বা পানির কলগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। টয়লেট টিস্যু বা হাত ধোয়ার জন্য সাবানের কোনো ব্যবস্থা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আপনি পেয়ে থাকলে আপনি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন। এই দুরবস্থা দেখে আপনার শঙ্কা হতে পারে, এখান থেকে আপনাকে নতুন কোনো রোগ বাঁধিয়ে ফিরতে হয় কিনা।
বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, দেখা গেছে, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট- যা অনেক লোক এক সঙ্গে ব্যবহার করে থাকে; সেখান থেকে জন জনান্তিকে নানাবিধ রোগ ছড়াতে পারে। পাবলিক টয়লেটের মাধ্যমে সচরাচর যেসব রোগ বা জীবাণু ছড়াতে পারে তার মধ্যে রয়েছে: ই-কোলাই, স্যালমোনেলা, নরোভাইরাস, এমআরএসএ, হেপাটাইটিস এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এমনকি কমন কোল্ড। কিছু ক্ষেত্রে এসব রোগের কারণে আপনার তীব্র পেটব্যথা, জ্বর ও শারীরিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে গলা ও ত্বকের সমস্যা দেখা যায়। কখনো কখনো রোগের উপসর্গ সপ্তাহখানেক স্থায়ী হতে পারে। কিছু বিরল ক্ষেত্রে এসব রোগের কোনো কোনোটির কারণে আপনার জীবন সংশয় হতে পারে। খুব গুরুতর নয় এমন ক্ষেত্রেও আক্রান্ত ব্যক্তি অফিস মিস করার মতো যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।
সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, বেশিরভাগ বাথরুমের জীবাণু টয়লেটের সিটে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো টয়লেটের মেঝে ও অধিক স্পর্শ লাগে এমন পৃষ্ঠসমূহ- যেমন ধরুন সিন্ক, কলের হাতল, হ্যান্ড ড্রয়ার, লাইটের সুইচ, দরজার নব- এসবে অনেক বেশি সংখ্যায় জীবাণুর উপস্থিতি থাকে। আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাবলিক টয়লেটের মেঝেতে প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ২০ লাখ ব্যাকটেরিয়া থাকে। কাজেই, আপনি যদি কোনো কিছু স্পর্শ নাও করেন, আপনার জুতার তলায় করেও আপনি জীবাণু বহন করে নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, মহিলাদের হ্যান্ডব্যাগ যদি টয়লেটের মেঝেতে বা সিন্েকর কাউন্টারে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেটার সঙ্গেও জীবাণুবাহিত হতে পারে। এ কারণে আপনার সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখার জন্য দরজায় বা দেয়ালে যে অন্তত একটি হুক থাকা দরকার সেটা কেন জানি অনেকের মাথায় আসতে চায় না।
এখন, আপনি যদি টয়লেটের জীবাণু বহন করছে এমন কোনো দূষিত বস্তু বা পৃষ্ঠ স্পর্শ করেন, পরে ঠিক মতো হাত না ধুয়ে ওই হাত ব্যবহার করে খাবার প্রস্তুত বা গ্রহণ করেন, তাহলে হাতে থাকা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন। এ ধরনের খাবার অন্য কেউ গ্রহণ করলে সেও সংক্রমিত হতে পারে। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ফ্লাশ করার সময় চারিদিকের বাতাসে ছড়িয়ে পড়া জলকণা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলেও আপনি তাতে থাকা জীবাণুতে সংক্রমিত হতে পারেন। কাজেই বুঝা যাচ্ছে, পাবলিক টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, এর মেঝে, দরজা ইত্যাদি নিয়মিত বিরতিতে জীবাণু মুক্ত করা, টয়লেটের বাতাস দূষণমুক্ত রাখা, টয়লেট বাহিত রোগব্যাধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া রোধ করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালের মতো জায়গায় এর গুরুত্ব সমধিক, কারণ এখানে নানারকমের রোগ ব্যাধি নিয়ে অসংখ্য মানুষ এসে থাকেন।
দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ব্যবস্থাপনার যে করুণ চিত্র আমরা ওপরে তুলে ধরেছি তা থেকে বেরিয়ে আসা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এই আলোচনা থেকে সহজেই অনুমেয়। টয়লেট ব্যবস্থাপনার করুণ দশার একটি কারণ হতে পারে, এসব হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়ে থাকেন। হতে পারে, টয়লেটসমূহ যত সংখ্যক লোক ব্যবহার করে তার তুলনায় ক্লিনিং স্টাফ সংখ্যায় অপ্রতুল। ঢিলেঢালা প্রশাসন এবং অপর্যাপ্ত নজরদারিও কারণ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। প্রশ্ন হলো, দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যদি একটা ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন স্যানিটেশন সিস্টেম মেইনটেন করা যায়, তাহলে সরকারি হাসপাতালসমূহে করা যাবে না কেন?
দেশে যানবাহনের ব্যস্ত রুটসমূহ, যেমন ধরুন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিপুলসংখ্যক যাত্রীর রিফ্রেশমেন্টের জন্য মাঝপথে যানবাহনসমূহ যাত্রাবিরতি করে থাকে। সেখানে এই বিপুলসংখ্যক যানবাহনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের প্রায় সবাই বিরতিকালীন রেস্টুরেন্টের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। আপনি কদাচিৎ দেখবেন, এগুলো ঠিক মতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। হজের সময় লাখ লাখ হাজি কাবা শরিফ ও মসজিদে নববীর টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করে থাকেন। এগুলোর ক্লিনিংয়ের ক্ষেত্রে কোনোরকম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আপনি কদাচিৎ পাবেন। তাহলে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহের টয়লেট ফ্যাসিলিটিজ- যেগুলো বড় জোর দৈনিক কয়েকশ' থেকে কয়েক হাজার লোক ব্যবহার করে থাকেন- যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এত কঠিন হবে কেন? ক্লিনারদের সংখ্যা অপ্রতুল হলে তাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। স্থায়ীভাবে ক্লিনারদের সংখ্যা বাড়ানো না গেলে প্রয়োজনে খন্ডকালীন ক্লিনার নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এটার জন্য বাজেট সংকট হওয়ার কথা নয়। আর যদি হয়েও থাকে, উন্নত স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে রোগীরা আলাদা চার্জ জোগাতে সানন্দে রাজি হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
শুধু জরাজীর্ণ টয়লেট ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহ উন্নত চিকিৎসাসেবা দিয়েও যে মারাত্মক ইমেজ সংকটে আছে, সে বিষয়টি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়