পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ ও ভারত
বাংলাদেশের পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা যদি এই শিল্পটির অস্থিরতা কমাতে না পারেন অদূর ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পটি ভারতের হাতে চলে যাবে। যেমন করে পাট শিল্প ভারত দখল করে নিয়েছে।
প্রকাশ | ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
পোশাক শিল্প হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮১.৮১ ভাগ আসে এই শিল্প খাত থেকে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে ছিল চীন। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু পোশাক শিল্প থেকে বিদেশি রেমিট্যান্স এসেছে ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চীন ও ভিয়েতনাম থেকে এ বছর ৪০ শতাংশ তৈরি পোশাক আমদানি করেছে; আর বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৯ শতাংশ। অপরদিকে, ভারত থেকে আমদানি করেছে ৫ দশমিক ৬৯ ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ভিয়েতনামে কমেছে বাংলাদেশের। অন্যদিকে, ভারতে সম্প্রসারিত হচ্ছে পোশাক শিল্পের বাজার। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কর্মাসের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্স)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চলতি বছরের সাত মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৩৬৩ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে- যা গত বছরের এই সময়ের চাইতে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশের পোশাক। বাংলাদেশে বর্তমানে চার হাজারের অধিক পোশাক কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের প্রসার ঘটেছিল খুবই দ্রম্নত। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পোশাক কারখানা ছিল মাত্র ৪৭টি, ১৯৮৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮৭টিতে, ১৯৯৯ সালে তার সংখ্যা হয় ২৯০০ আর ২০০৯ সালে তার সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজারের অধিক- যা বর্তমানে চার হাজারের বেশি। ১৯৯০ সাল থেকে এই শিল্পের বার্ষিক সম্প্রসারণ হার প্রায় ২২ শতাংশ। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশ আয় করেছে ০.৯ বিলিয়ন ডলার- যা ছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩.৮৯ শতাংশ। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে পোশাক খাত থেকে পাওয়া যায় ৫.৫১ বিলিয়ন ডলার- যা মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫.৬৭ শতাংশ। তবে নিট বৈদেশিক আয় ছিল এ খাত থেকে ৩০ শতাংশ। কারণ বাদবাকি অংশ পোশাক শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ কিনতে আমদানি ব্যয় মিটাতে হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে এ শিল্প ৪৬৮০০.০০ মিলিয়ন ডলার। ৪ মার্চ, ২০২৪ বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে। পোশাক শিল্প কারখানার কর্ম পরিবেশ নিয়ে ছিল নানা ধরনের প্রশ্ন। আজ থেকে এক যুগ আগে পরিবেশবান্ধব সবুজ পোশাক কারখানা ছিল মাত্র একটি। এখন সেই সংখ্যা বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ২১৪টিতে। বর্তমানে বিশ্বের ১০০টি পোশাক কারখানার মধ্যে ৫৬টিই বাংলাদেশে। ২৮ মে, ২০২৪ এসে বাংলাদেশের ২১৮টি পোশাক কারখানা পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এসে এর সংখ্যা বেড়ে তা দাঁড়ায় ২২৯টিতে।
বর্তমানে প্রতি বছর শত শত নতুন কারখানা হচ্ছে। অপরদিকে, বন্ধও হচ্ছে শত শত কারখানা। এর কারণ বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকাটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশসহ শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর, পোশাক শিল্পে দেখা দিয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা। কারখানাগুলোতে সৃষ্টি হয়েছিল চরম বিশৃঙ্খলা- যা এখনো অনেক জায়গায় চলছে। এই বিশৃঙ্খলার মূল কারণ শ্রমিকরা নিয়মিত বেতন না পাওয়া, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং নতুন করে পে-স্কেল ঘোষণা করা ইত্যাদি দাবিতে। গত মাসের ১৪ তারিখে ঢাকার উত্তরায় বিজিএমই ভবনে পোশাক শিল্পের সংকট নিয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই মতবিনিময় সভা পর পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি সাধন হয়নি। দিন দিন বাড়ছে কারখানা ভাঙচুরের মতো ঘটনা। শ্রমিকরা পক্ষ-বিপক্ষ আন্দোলন করে একে অন্যকে হেনস্তা করছে। রাজপথ অবরোধসহ গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ পোশাক কারখানা ঢাকার আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত। এই কারখানার অসন্তোষের কারণে এই এলাকাগুলোতে দেখা যাচ্ছে নানা রকমের বিশৃঙ্খলা। এলাকার সামাজিক শান্তি নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থার দ্রম্নত নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। পোশাক কারখানা দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই শিল্পে বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমজীবী। কোনো কারণে এই শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে সারাদেশে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। সামাজিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। একটি গণমাধ্যমের সূত্র থেকে জানা যায়, গত ২ অক্টোবর ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা সড়কে ৫২ ঘণ্টা অবরোধ ডাকে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তারপর পুলিশের আশ্বাসে দুপুর একটার দিকে তা প্রত্যাহার করে শ্রমিকরা। চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন করে বন্ধ হয়ে যায় ১০টি কারখানা। চাকরিচু্যত শ্রমিকদের পুনর্বহাল এবং পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে গাজীপুরের ভোগরা এলাকায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে। এই অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। তখন মালিকরা ওই এলাকার ১০টি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় বিক্ষোভের মূল কারণ হলো শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা। এই ধারায় বলা আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা বিভাগে বেআইনি ধর্মঘটের কারণে মালিকরা ওই শাখা আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে পারে এবং এ রূপ ধর্মঘটে বন্ধ হওয়ার কারণে ধমর্ঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা কোনো মজুরি পাবে না। এই আইনের কারণে বন্ধ হওয়া অনেক গার্মেন্ট শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন পাচ্ছেন না। এই আইনের ফলে শ্রমিকরা পাচ্ছে না তাদের নায্যতা। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে নারী ও পুরুষ শ্রমিক দ্বন্দ্ব। ওই আইনের কারণে মালিকরা শ্রমিক আন্দোলনকে নাশকতা বলে আখ্যা দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের অস্থিরতার কারণে বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের অর্ডার ফেরত নিচ্ছে। অপরদিকে, সময়মতো বায়ারদের কাছে পণ্য পাঠাতে পারছে না পোশাক মালিকরা। এর ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের পোশাক শিল্পের কদর বাড়ছে। ভারতের ব্যবসায়ীরা শ্রমঘন শিল্পের চেয়ে পুঁজিঘন শিল্পের দিকে বেশি আগ্রহী। তাই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পোশাক শিল্পের দিকে আগ্রহ কম ছিল। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে নতুনভাবে ভারতীয় তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার কারণে এই বাজারটা হয়তো ভারতের দখলে চলে যেতে পারে। অর্থ মূল্যের দিক থেকে ২০২৩ সালে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে কম পোশাক রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশ যে পরিমাণে পোশাক রপ্তানি করেছিল ভারত সেই তুলনায় করেছে তার মাত্র ২৫ শতাংশ। সম্প্রতি ভারতের তামিল নাড়ু প্রদেশের ত্রিপুরা শহরের পোশাক প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ৫৪ মিলিয়ন ডলারের নতুন পোশাক উৎপাদনের কার্যাদেশ পেয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতের অস্থিরতার জন্য তাদের কাছে এই কার্যাদেশ এসেছে। বিভিন্ন পোশাক উৎপাদনগোষ্ঠী বলছে আগস্ট মাসে বৈশ্বিক ব্রান্ড জারার কাছ থেকে গত সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি পোশাক রপ্তানির কার্যাদেশ পেয়েছে ভারতীয় পোশাক প্রস্ুত্মতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্চ থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে। গত বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় এ বছরের আগস্ট মাসে ভারতের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ শতাংশ। শুধু আগস্ট এক মাসে ভারতের পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে ১২৬ কোটি ডলার। এ বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত পোশাক খাত থেকে ভারতের আয় ৬৩৯ কোটি ডলার।
এই ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, ভারতের পোশাক খাত একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে এগুচ্ছে। ভারত এখন তৈরি পোশাক খাতে উচ্চ সম্ভাবনাময় প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে পা বাড়াচ্ছে। পরিবেশ ও সমাজের খেয়াল রাখার পাশাপাশি পণ্যের মান বাড়িয়ে বিশ্বের তৈরি পোশাক সেক্টরে বড় অংশ দখল করতে যাচ্ছে ভারত। ভারতের এইপিসির সেক্রেটারি জেনারেল মিথিলেশ ঠাকুর বলেছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারতের পোশাক শিল্প খাত উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখছে। বিদেশি ব্রান্ডগুলো যে ভারতের ওপর আস্থা বাড়াচ্ছে তা স্পষ্ট।
বাংলাদেশের পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা যদি এই শিল্পটির অস্থিরতা কমাতে না পারেন অদূর ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পটি ভারতের হাতে চলে যাবে। যেমন করে পাট শিল্প ভারত দখল করে নিয়েছে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক