বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১

আর কতজন জীবন দিলে 'মব জাস্টিস' বিলুপ্ত হবে?

সামিয়া জামান
  ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আর কতজন জীবন দিলে 'মব জাস্টিস' বিলুপ্ত হবে?

আমরা কয়েকদিন একটি শব্দযুগল হয়ত কয়েক শতবার শুনেছি ও পড়েছি। সেটা হলো 'মব জাস্টিস'। মব জাস্টিস বলতে সাধারণভাবে বোঝায়, জনতা আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়া। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটানো কিংবা জনতা দ্বারা বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর সবকিছুই মব জাস্টিসের অংশ। বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়াটা কী? দেখেন, একজনকে আপনি যদি চোর হিসেবেও ধরতে পারেন, আপনার সর্বোচ্চ দায়িত্ব হলো প্রশাসনের হাতে হস্তান্তর করা। আপনি তাকে চোর হিসেবে ধরেছেন বলেই তাকে হত্যা করতে পারেন না। আর যারা এসব করে, তারাই নিজের হাতে আইনকে তুলে নিয়ে থাকে, যা কখনই আইনসঙ্গত নয়।

আসলে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশজুড়ে বড় আকারে 'মব জাস্টিস' শুরু হলেও বাংলাদেশে এই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিনবাজারে 'ডাকাত' সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছিল ছয় ছাত্রকে। ২০১৯ সালে বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেনু নামের এক মাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। সম্প্রতি এমন আরও একটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতে ও ঢাকায়। গত কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তোফাজ্জল নামক এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন মানসিক রোগী। অভিযোগ, তিনি চুরি করতে সেখানে গিয়েছিলেন। কেউ চুরি করতে এলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করতে হবে কেন? অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একজনকে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে।

ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১-২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।

দেখা যাচ্ছে, উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষার্থীরাও এমন গর্হিত কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এখন সবার মনে একটাই প্রশ্ন, 'মব জাস্টিস' নামক এই ভয়ংকর ঘটনাটি বারবার কেন ঘটছে? আর কতজনের জীবন হারালে এই জঘন্য কালচারের বিলুপ্তি হবে? 'মব জাস্টিস' ঘটার কয়েকটি বিশেষ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো- আইন ও প্রশাসনের দুর্বলতা। রাজশাহীতে একটি ঘটনা ঘটল এরপর আবার এক জায়গায় ঘঁল, এরপর আবার এক জায়গায় ঘটছে। পরপর এমন কাজটি ঘটানোর সাহস কীভাবে পাচ্ছে তারা। প্রশাসনকে পূর্ণাঙ্গভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে এসব বিষয়ে। আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে হতে হবে। সব সময় পুলিশ প্রশাসনকে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। সাম্প্রতিককালে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাধারণ মানুষের কাছে একটি বিষয় নিয়ে শোনা যাচ্ছে যে, পুলিশরা নিজেরাই তাদের নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশকেও ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা দেখা যাচ্ছে, রাস্তাতে রিকশাওয়ালাই ট্র্যাফিক পুলিশকে মানছে না আর তো অন্যরা। এভাবে চলতে থাকলে হয় এই বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকল আরও দীর্ঘ হতে পারে। মব জাস্টিসের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটার পর সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন থেকে দুঃখ প্রকাশের বিবৃতি সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ না করে উপযুক্ত শাস্তি ও আইনের আওতায় নিয়ে আসা নিশ্চিত করতে হবে। এক কথায় আইনের যথাযথ প্রয়োগে কোনোভাবেই দুর্বলতা দেখানো যাবে না। এই আইন ও প্রশাসনের দুর্বলতার পাশাপাশি আরও কিছু কারণ আছে, যার কারণে এই গর্হিত কাজটি বারবার ঘটে আসছে সেই অনেক আগে থেকে। সেগুলো হলো- ক্ষোভ, রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক প্রভাব, সামাজিক বৈষম্য, বিচার বিভাগের দুর্বলতা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতা ইত্যাদি। আমাদের সবার উচিত, দেশের আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া, দেশের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ওপর আস্থা রাখা আর দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও উচিত জনগণের আস্থাকে সম্মান করে আইন, বিচার ও প্রশাসনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

মো. আব্দুল ওহাব

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংগঠনের স্বাধীনতা

সংগঠন বলতে মানুষের লক্ষ্য অর্জনের জন্য একত্রিত হয়ে গঠিত সংঘকে বোঝায়। অর্থ্যাৎ সংগঠন মানুষের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং চাহিদা পূরণের কাজ করে থাকে। মানুষ তাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে তোলে। যেমন- সুষ্ঠু রাজনীতি বজায় রাখতে বা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অংশ নেওয়ার জন্য মানুষ রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে। সমাজের নানাবিধ সমস্যা দূরীকরণে, সমাজকে সুষ্ঠু এবং সুন্দর রাখতে সমাজের মানুষজন বিভিন্ন প্রকার সামাজিক সংগঠন তৈরি করে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা দূর করতে, একটি রাষ্ট্রের সুন্দর অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে অর্থনৈতিক সংগঠন তৈরি হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র, সমাজ এবং সমাজব্যবস্থা সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের উদ্ভব হয়ে থাকে এবং এসব সংগঠন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠে। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অপসংগঠনের উদ্ভব হয় এবং এগুলো দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক খাতগুলোকে নষ্ট করে দিতে উদ্যত হয়। দেশে ধর্মীয় দাঙ্গা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এ ধরনের সংগঠনগুলো সরাসরি আইনবিরোধী সংগঠন হয়ে থাকে। যেহেতু সংগঠন একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেহেতু আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রের আইন মেনে সংগঠন তৈরি করা উচিত। আমরা বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৮-অনুচ্ছেদে দেখতে পাই, 'সংগঠনের স্বাধীনতা' সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে। আমরা অনুচ্ছেদ-৩৮ এ দেখতে পাই,- 'জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে (১) সমিতি, (২) সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত থাকে, কোনো ব্যক্তি ওই সমিতি বা সংগঠন করার বা তার সদস্য হওয়ার অধিকারী হবে না, যদি (ক) তা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য গঠিত হয়। (খ) ধর্মগোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে গঠিত হয়। (গ) তা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে বা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গিকার্য পরিচালানার জন্য গঠিত হয়। (ঘ) তার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধান পরিপন্থি। অর্থাৎ আমরা অনুচ্ছেদ-৩৮ বিশ্লেষণ করে বলতে পারি, সংগঠন তৈরি করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। আমরা দেশের কল্যাণার্থে, নৈতিকতার স্বার্থে দেশের বিভিন্ন কাজে ভূমিকা রাখতে আইনের যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সংগঠন তৈরি করতে পারব। কিন্তু যদি সংগঠন দ্বারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ঘটে, সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট হয়, নারী-পুরুষে, বর্ণ, ভাষার মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয় এবং অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংঘটিত হয় তবে সংবিধান পরিপন্থি হবে। তাই আমাদের উচিত সংবিধান মেনে সংগঠন তৈরি করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা এবং অপসংগঠন বা সংবিধানবিরোধী সংগঠনগুলো বর্জন করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।

সামিয়া জামান

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে