সংঘাত কি পরিকল্পিত?
প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
মারুফ হাসান ভূঞা
পাহাড়ে আবারও সংঘাত, পাহাড় ঘিরে সংঘাত এ দেশের রাজনীতিতে কারও জন্য উৎপাদিত ঐশ্বরিক শক্তি। আবার কারও জন্য শোষণের উপাদান। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যকার বলি করা হচ্ছে? কেবল মানুষ, পাহাড় প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলই অপব্যবস্থার ওপর ভর করেছে। কারণ, ভোট রাজনীতি, ভোট চাহিদা রক্ষার তাগিদ। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে পাহাড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত। কারণ, বর্ণবাদ সংস্কৃতি, বর্ণবাদ সংস্কৃতি পৃথিবীতে মানুষের ওপর মানুষ ধারা অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে মানসিক, দৈহিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগতভাবে নিপীড়ন করা। যা পৃথিবীর প্রায় দেশে এখনো ব্যাপকভাবে সমাদৃত। সেই আবহ বাংলাদেশেও রয়েছে। সেটি অত্যন্ত তীর্যকভাবেই রয়েছে। তীর্যকভাবে থাকার কারণ এখানকার শাসনব্যবস্থা চাই এটি একটি মাত্রায় বৃদ্ধ মান থাকুক। কারণ, শাসনব্যবস্থা মনে করে, এই সংঘাত বৃদ্ধমান যত বেশি থাকবে, তত শোষণ করা সহজলভ্য হবে।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ধর্ম, তাদের সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সে সংস্কৃতিকে বারবার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। প্রথমত ভাষা, পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে। এই বিচ্ছিন্নতাও কৃত্রিম উপায়ে রূপান্তর করা হয়েছে। সেটি তৈরি করেছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলগুলোর কাঠামো। উপজাতি শব্দের ব্যবহার, অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভূমি সেটেলমেন্টের চর্চা। এটিও সে পরিকল্পনার অংশ। এখনকার ক্ষমতাসীন দলগুলো কখনোই পাহাড় সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ নেইনি। দৃশ্যমান ভোট রাজনীতির উদ্যোগ ঠিকই নিয়েছে, এবং এই পাহাড় একটি সমস্যা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে এই ভোট রাজনীতির অংশ হিসেবেই। জিয়া শাসনামলে এই ভোট রাজনীতকে মুখ্য করে পাহাড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাঁচ লাখের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যাওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে।
সেই সংখ্যা এখন বেড়েছে কয়েকশত গুণ। হঠাৎ এমন তৎপরতা কোনো অঞ্চলে হলে স্বাভাবিকভাবে সে অঞ্চলের মানুষরা আতঙ্কে থাকে। সে আতঙ্ককে আতঙ্ক হিসেবেই উপস্থাপন করা হয় ভূমি ব্যবস্থা দিয়ে। ভূমি ব্যবস্থার বিরোধেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সংকট, সেখানে দীর্ঘদিন বসবাস করা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি সমস্যা নিরসন হতো ব্রিটিশ কিছু প্রথাগত আইন অনুযায়ী। কিন্তু হঠাৎ করে একটা বিপুল অংশের মানুষকে আগাম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমর্থন কিংবা মতামত না নিয়ে স্থানান্তরিত করা, আবার সঙ্গে সঙ্গেই আইন পরিবর্তন করা। একটি অঞ্চলের মানুষের জন্য তো দুশ্চিন্তা হবেই। এর সঙ্গে বাঙালি সেটেলাররা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় জাতিগত বিদ্বেষ, বর্ণবাদী আচরণ, এসব ঘিরে সংঘাত।
একপর্যায়ে হঠাৎ আবিষ্কৃত হয় সেনাশাসন, ঠিক এই মুহূর্তে একজন আদিবাসী নাগরিকের স্বাভাবিক চিন্তা কি হতে পারে? নিরাপত্তাহীনতা। সেই নিরাপত্তাহীনতার কথা বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রকাশ করে। তখনই আবার শুরু হয় জাতিগত বিদ্বেষ, সংঘাত বাঙালি আদিবাসী সংঘাত। সে সংঘাতে প্রতিনিধিত্ব করেছে সেনাবাহিনী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি বিচ্ছিন্ন অংশ। আমরা যদি সংঘাতগুলো ঘেঁটে দেখি, তাহলে দৃশ্যমান হবে ১৯৮০, ১৯৮১ সালে বিচ্ছিন্ন বাঙালি মুসলমানদের একটি অংশ ককজলি গ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৩০০ জনকে হত্যা করে। সে বছরই আরও একটি গণহত্যা পরিচালিত হয় প্রায় তিন থেকে চার হাজার মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হয়।
\হ১৯৮৬, ১৯৮৯ সালসহ বিভিন্ন সময় প্রায় চার থেকে পাঁচশত আদিবাসী হত্যাকান্ডের শিকার হন। লোগাংয়ে ১৯৯২ সালে শত শত লোককে হত্যা করা হয় এবং সেই হত্যাকান্ডে জীবন্ত পুড়ে ফেলাসহ আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাহাড়ে আদিবাসী প্রায় এক হাজার নারী ধর্ষণের স্বীকার হন। যার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর জড়িত থাকার সংবাদও রয়েছে। পাহাড়ি আদিবাসী নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের পেছনে বেশির ভাগই নিরাপত্তা বাহিনী ও উচ্ছৃঙ্খল সেটেলার বাঙালির একটি অংশের সম্পৃক্ততা ছিল।
পাহাড়ে আদিবাসীদের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ, যাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। যাদের সঙ্গে বেশির ভাগই সম্পৃক্ততা নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা যখন যে সরকার আসে, সে সরকার দলীয় সংসদ। এদের উৎপাদন করা হয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে উচ্ছৃঙ্খল হিসেবে উপস্থাপনের জন্য। কিন্তু কেন এমনটি করে? আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও সেটেলার বাঙালিরা যখন নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া শুরু করল তখনই ষড়যন্ত্র শুরু করা হয় সাম্প্রদায়িক অরাজকতা সৃষ্টির। আর ঠিক ওই মুহূর্তে কিছু সশস্ত্র বাহিনী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভেতরই তৈরি করা হয়। অর্থাৎ প্রক্সি গ্রম্নপ, যা নিরাপত্তা বাহিনীর আস্কারাতেই তৈরি। আমরা সাম্প্রতিক সময়ও দেখেছি, কুকি-চিন আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, সে কুকি-চিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একসময় এক গন্ডিতে কাজ করত। সে কুকি-চিন যখন সশস্ত্র কিংবা বিশৃঙ্খলা করা শুরু করল পাহাড়ে তখন সেনাবাহিনী বম জনগোষ্ঠীর মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করল।
পাহাড়ে উন্নয়নের আদিবাসীদের উচ্ছেদ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি উন্নতমানের হাসপাতাল পর্যন্ত নেই। উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নেয়, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধিবাসী জনসংখ্যা অনুপাতে খুব সীমিত। পানির সংকট ভয়াবহ, আমরা মাঝে মধ্যেই সে সংবাদ পাই।
অর্থাৎ পাহাড়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যে ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থাকা প্রয়োজন, সেসবের সংকট উচ্চমাত্রায়। নেই বলতে নেই। কিন্তু রয়েছে উচ্চ বিলাসী হোটেল, রেস্তোরাঁ। আবার সেসবের আভিজাত্য। পাহাড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি দখলে নতুন সংযুক্ততা হোটেল, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের। তাদের দখলদারত্বির বোঝাও রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর। একটা জনগোষ্ঠীকে চতুর্মাত্রিক সংকটে রেখে, আবার তাদের ওপরই সব রকম দায়ভার দেওয়া হয়। কিন্তু কেন?
মারুফ হাসান ভূঞা
ধানমন্ডি, ঢাকা।